টিকা নিয়ে তথ্য: মিথ্যা নাকি সত্য
0
ভ্যাক্সিন বা প্রতিষেধক টিকার দীর্ঘদিনের ইতিহাস বিবেচনা করলে দেখা যাবে এই ইতিহাস একেবারে মসৃণ তো ছিলই না বরং ছিল হাজার হাজার উত্থান-পতন। কিছুদিন আগেও ভ্যাক্সিনকে রোগ প্রতিরোধকারী আধুনিক প্রযুক্তির আশীর্বাদ হিসাবে দেখা হলেও বর্তমানে অনেকেই বিভিন্ন টিকাকে সন্দেহ ও বিতর্কের দৃষ্টিতে দেখেন।
আমরা কি আসলে কখনো প্রতিষেধক টিকার ক্ষতিকর প্রভাব ও উপকার নিয়ে ঐক্যমতে পৌছাতে পারবো? সে প্রশ্ন না হয় থাক। আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে প্রতিষেধক নিয়ে তথ্যের সত্য-মিথ্যা বিশ্লেষণ।
১। কিছু ভ্যাক্সিনে ক্ষতিকর পারদ থাকে
|| আসলেই সত্য ||
কিছু ভ্যাক্সিন রয়েছে যাতে থিমেরোসাল নামক রাসায়নিক সংরক্ষক পদার্থ ব্যবহার করা হয় যার ভর অনুপাতে ৫০% উপাদান হলো পারদ। ভ্যাক্সিনে এই সংরক্ষক পদার্থের মূল কাজ হলো ভ্যাক্সিনকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা। পারদ রোগজীবাণুর পাশাপাশি মানুষের জন্যেও ক্ষতিকর। তবে আশার কথা, ২০০১ সাল থেকে ৬ বছর অপেক্ষা কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য প্রস্তুতকৃত ভ্যাক্সিনে এই থিমেরোসাল ব্যবহার করা হয় না। প্রাপ্তবয়স্ক ও ৬ বছর অপেক্ষা বড় বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা ভ্যাক্সিনেরও থিমেরোসাল-মুক্ত বা অতি কম পরিমাণ থিমেরোসাল-যুক্ত সংস্করণ পাওয়া যায়।
২। কিছু ভ্যাক্সিন অটিজম রোগ তৈরি করতে পারে
|| প্রচলিত ধারণা ||
১৯৯৮ সালে আন্ড্রু ওয়েকফিল্ড নামে একজন বিজ্ঞানী ছোট্ট একটি গবেষণা করে দাবি করেন তিনি measles, mumps, and rubella (MMR) vaccine এর সাথে অটিজমের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। এটি মানুষের মাঝে ভয় সৃষ্টি করে যার ফলশ্রুতিতে একদিকে টিকা কার্যক্রমে যেমন ভাটা পড়ে অপর দিকে রোগের প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায়।
পরবর্তীতে করা নানা গবেষণায় দেখা যায় পূর্বে প্রকাশিত গবেষণা ফলাফলটিতে ভুল ছিল, এমনকি গবেষণাপত্রটিও জার্নাল কর্তৃপক্ষ ভুল স্বীকার করে তুলে নেয়। ২০০৪ সালে দি মেডিসিন ইন্সটিটিউট MMR vaccine ও অটিজমের মধ্যে কোনো বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক নেই বলে রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০১০ সালে আমেরিকার CDCও একই রকম একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে।
৩ – ভ্যাক্সিনেরও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে
|| আসলেই সত্য ||
ভ্যাক্সিনগুলো মোটেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত নয়। ভ্যাক্সিনের যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো ইনজেকশন দেবার স্থানে লাল হয়ে যাওয়া এবং সামান্য জ্বর যা প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধে ঠিক হয়ে যায়। অপরদিকে কম দেখা যায় এমন কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে মাংসপেশির সামান্য খিঁচুনি। MMR vaccine এর ক্ষেত্রে প্রায় ৩০০০ বাচ্চার মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে এই খিঁচুনি দেখা দিতে পারে যা নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়। তবে এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা ভ্যাক্সিনের প্রকারভেদের উপর নির্ভরশীল তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব কম। প্রকৃতপক্ষে ভ্যাক্সিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত বিরল ক্ষতি এবং ভ্যাক্সিন দেওয়ার প্রভূত উপকারিতার তুলনামূলক বিবেচনায় ভাক্সিন না দেওয়াটা বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
৪। সবাই ভাক্সিন দিলে আমিও নিরাপদ
|| প্রচলিত ধারণা ||
ভ্যাক্সিন দেওয়া হয় রোগের জীবাণু যেন কারো দেহে প্রবেশ করে রোগ সৃষ্টি করতে না পারে ও জীবাণুটি যাতে অন্য মানুষে না ছড়িয়ে পড়ে। তাই অনেকের ধারণা সবাই ভ্যাক্সিন দিলে যেহেতু তারা রোগ ছড়াতে পারবে না তাই আমি ভ্যাক্সিন না দিয়েও নিরাপদ থাকবো।
কিন্তু প্রকৃত চিত্র আসলে কিছুটা ভিন্ন। রোগের জীবাণু সব সময় যে মানুষের কাছ থেকেই আসবে এমন নয়, তা ছাড়া সমাজের সকল স্তরের সকল মানুষকে ভ্যাক্সিন দেওয়া সম্ভব হয় না। কিছু রোগের (যেমনঃ টিটেনাস, হেপাটাইটিস এ ইত্যাদি) জীবাণু মাটি কিংবা খাদ্য-পানীয় থেকে সংক্রমিত হয়ে থাকে। কিছু জীবাণুর পোষক মানুষ ভিন্ন অন্য প্রাণী হতে পারে। তাই নিজের সুরক্ষার জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেই ভ্যাক্সিন নিয়ে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।
৫। ভ্যাক্সিন সুস্থ থাকার নিশ্চয়তা দেয়
|| প্রচলিত ধারণা ||
ভ্যাক্সিন কখনোই সুস্থ থাকার ১০০% নিশ্চয়তা দেয় না, তবে ভ্যাক্সিন রোগ জীবাণুর সাথে আমাদের চলমান যুদ্ধে অনেক বেশি প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়। সাধারণ সর্দিজ্বরের জীবাণুর (ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস) বিপরীতে ভ্যাক্সিন নেবার পরও যে কেউ সাধারণ সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে কারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের অনেকগুলো প্রকরণ রয়েছে যার সবগুলো ভ্যাক্সিনে অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে ভ্যাক্সিনে অন্তর্ভুক্ত নয় এমন প্রকরণ দ্বারা ভ্যাক্সিন নেওয়া মানুষের দেহে রোগ সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও কিছু কিছু ভ্যাক্সিন তার অন্তর্ভুক্ত প্রকরণের বিপরীতে ১০০% সুরক্ষা দেয় না। তবে সব চেয়ে ভালো দিক হলো ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরও যদি রোগ হয় তবে সে রোগ আক্রান্ত করে বটে কিন্তু খুব বেশি ক্ষতি করতে পারে না বা জটিল অবস্থা সৃষ্টি হয় না। তবে কিছু রোগ প্রতিরোধে ভ্যাক্সিন কার্যক্ষেত্রে ১০০% সফল (যেমনঃ পোলিও)।
৬। বার বার ভ্যাক্সিন নিলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়
||প্রচলিত ধারণা ||
এটি প্রকৃত চিত্রের পুরোপুরি বিপরীত। ভ্যাক্সিনের প্রতিটি ডোজ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থকে শক্তিশালী করে এবং দেহে নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সাহায্য করে যা সত্যিকারের জীবাণু দেহে প্রবেশ করলে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে আমাদের সাহায্য করবে। একাধিক বার ভ্যাক্সিন দেওয়া হয় মূলত পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিবডি উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য।
৭। ভ্যাক্সিন শুধুমাত্র বাচ্চাদের জন্য
|| প্রচলিত ধারণা ||
যদিও ছোট বাচ্চাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বড়দের তুলনায় দুর্বল হয় বলে তারা ছোট থাকতেই তাদের অনেক ধরনের টিকা দেওয়া হয় কিন্তু তার মানে এই নয় যে ভ্যাক্সিন শুধু বাচ্চাদের জন্যই তৈরী। যে সকল রোগ কম বয়সে হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে সেগুলো শৈশবেই দিয়ে দেওয়া হয়। তবে একই ভ্যাক্সিন বড়দের জন্যও আলাদা করে তৈরি করা হয়। যেমনঃ বাংলাদেশ সরকারের EPI কর্মসূচীর আওতায় ছোট বাচ্চাদের পেন্টাভ্যালেন্ট নামক টিকা দেওয়া হয় যা তাদের ডিপথেরিয়া, পারটুসিস, টিটেনাস, হেপাটাইটিস বি ও হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জি বি এর বিপরীতে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু এটি কিছুদিন আগে কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় যারা ছোট বেলায় এই ভ্যাক্সিন পাননি তারা আলাদা করে কিনে এটি দিতে পারবেন, এতে বয়স কোনো সমস্যা নয়।
৮। গর্ভবতী মায়েরা ভ্যাক্সিন দিতে পারবেন না
|| প্রচলিত ধারণা ||
এটি আসলে আংশিক সত্য। আমেরিকান একাডেমি অব ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানের মতে গর্ভস্থ শিশুর উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় গর্ভবতী মায়েরা কিছু ভ্যাক্সিন নিতে পারেন না। যেমন: চিকেনপক্স, মিজেলস (হাম), মাম্পস, রুবেলা রোগের ভ্যাক্সিন। কিন্তু টিটেনাস জীবাণুর বিপরীতে ভ্যাক্সিন নিতে পারবেন। আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো গর্ভবতী অবস্থায় নেওয়া ভ্যাক্সিন শুধু মাকেই নয় বাচ্চা জন্মের পর প্রায় ৬-৯ মাস (ভ্যাক্সিনের প্রকার অনুসারে আলাদা হয়) সময় পর্যন্ত বাচ্চাকেও সুরক্ষা দিতে পারে। আর যেসব ভ্যাক্সিন গর্ভস্থ শিশুর জন্য অনুপযুক্ত ছিল, জন্মের পর নির্দিষ্ট বয়সে দিলে সেগুলোই আবার ওই শিশুর জন্য সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
৯। ভ্যাক্সিনের চেয়ে প্রাকৃতিক সুরক্ষাই ভালো
|| আসলেই সত্য ||
প্রকৃতপক্ষে কোনো জীবাণুর ক্লিনিক্যাল বা সাবক্লিনিক্যাল ইনফেকশন ঐ রোগের বিপরীতে সারা জীবনের মতো প্রতিরক্ষা তৈরি করে যা অনেক সময় ভ্যাক্সিনও তৈরি করতে পারে না। যেমনঃ চিকেন পক্স রোগের ভ্যাক্সিন ১০ বছর পর্যন্ত সুরক্ষা দেয় তবে যার জীবনে একবার চিকেন পক্স হয়েছে তার সাধারণত একেবারেই হবার সম্ভাবনা নেই (যদিও বিরল ক্ষেত্রে একই ব্যক্তির তিনবার পর্যন্ত চিকেন পক্সে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে)। এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সুরক্ষা নিঃসন্দেহে ভ্যাক্সিনের চেয়ে ভালো।
তবে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে চিকেন পক্স রোগ থেকে মুক্তি পেতে আপনি কী নিজে চিকেন পক্স রোগে আক্রান্ত হতে চান? কিংবা আপনার ছোট শিশুকে এই রোগে আক্রান্ত করতে চান? যদি উত্তর না হয় তবে আপনার জন্য ভ্যাক্সিনই উত্তম।
এছাড়াও কিছু জীবাণু দ্বারা আক্রমণ রোগ থেকে সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয় না (যেমনঃ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস) কেননা এই সকল রোগের জীবাণু এত দ্রুত বিবর্তিত হয় যে প্রায় প্রতিনিয়ত বদলে যায়।
১০। রোগ নির্মূল হয়েছে তাই ভ্যাক্সিনের দরকার নেই
|| প্রচলিত ধারণা ||
ইতিমধ্যে পোলিও আমাদের দেশ থেকে নির্মূল হয়েছে যা আমাদের দেশবাসীর জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। টিকা প্রদান কার্যক্রমের সাফল্যের জন্যই মূলত আমরা পোলিও মুক্ত হতে পেরেছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমাদের দেশে এখন পোলিও রোগের ভ্যাক্সিন দেবার আর কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ আমাদের দেশ থেকে নির্মূল হলেও সারা বিশ্ব থেকে পোলিও রোগ নির্মূল হয়নি ফলে আমরা যদি এখন শিশুদের এই টিকা দেওয়া বন্ধ করি তবে সে বিশ্বের অন্য কোনো প্রান্তে গিয়ে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে কিংবা রোগাক্রান্ত কোনো শিশু বা পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি রোগ লক্ষণ দেখানোর আগেই এ দেশে এসে আমাদের মাঝে এই রোগ ছড়াতে পারে। তাই সব দিক বিবেচনা করে আমাদের দেশ পোলিওমুক্ত হলেও আমাদের এই পোলিও রোগের বিপরীতে টিকাদান কর্মসূচী চালিয়ে যেতে হবে। একমাত্র তখনই কোনো রোগের টিকা দেওয়া বন্ধ করা যেতে পারে যখন গোটা বিশ্বে ওই রোগের জীবাণু কারো শরীরে কিংবা অন্য কোনো উৎসে – কোথাও খুঁজে পাওয়া না যায়। যেমন: গুটিবসন্ত সারা পৃথিবী থেকে নির্মুল হওয়ার পর এখন আর তার টিকা দেওয়া হয় না।
১১। ভ্যাক্সিন আসলে রোগেরই জীবাণু
|| প্রচলিত ধারণা ||
এই ধারণাটি আংশিক সত্য। অধিকাংশ ভ্যাক্সিন রোগের জীবাণুকে বিশ্লেষণ করেই প্রস্তুত করা হয়। যে কোনো রোগকে হারাতে গেলে আমাদের সবার আগে ঐ রোগের জীবাণু ও রোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে নষ্ট করে তার যে অংশ প্রাণীদেহে অ্যান্টিবডি উৎপাদন করতে সাহায্য করে তা ভ্যাক্সিন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তবে এটিই ভ্যাক্সিন তৈরির একমাত্র মাধ্যম নয়। তাছাড়া ভ্যাক্সিন জীবাণু থেকে গবেষণার মাধ্যমে তৈরি করা হয় বলে সেটি কিন্তু সরাসরি জীবাণু নির্মিত নয়।
১২। ভ্যাক্সিন আসলে চিকিৎসকদের টাকা উপার্জনের মাধ্যম
|| প্রচলিত ধারণা ||
অনেকেই মনে করেন ভ্যাক্সিন দিতে বলে চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানীর কাছ থেকে উপঢৌকন আদায় করেন। কিন্তু বিষয়টি একেবারেই সত্য নয়। ভালো করে ভেবে দেখুন রোগ কম হলে তাতে কী চিকিৎসকের লাভ নাকি উল্টো ক্ষতি? কিন্তু তাঁরা আসলে এসব লাভ ক্ষতি বিবেচনা না করে সবাইকে ভ্যাক্সিন দিতে বলেন এই কারণে যে এতে সমাজে রোগের প্রাদুর্ভাব কম হয়। কথায় আছে “প্রতিরোধ প্রতিকারের চেয়ে ভালো”।