হেপাটাইটিসঃ প্রতিরোধের এখনই সময়
0
হেপাটাইটিস
কী?
ধারণা
করা হয় বিশ্ব জুড়ে বর্তমানে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন লোক হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি
ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। অপরদিকে প্রতি বছর প্রায় ১.৪ মিলিয়ন লোক হেপাটাইটিস রোগে
মারা যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় হেপাটাইটিস বলতে যকৃতের প্রদাহ কে বোঝায়।
হেপাটাইটিস নামক রোগে যকৃতের কোষ নষ্ট হয়ে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় হেপাটাইটিস
সাধারণ সর্দি জ্বরের ন্যায় লক্ষন প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে লক্ষণগুলো সর্দিজ্বর থেকে
আলাদা হয়।
কী কারণে
কী ভাবে হতে পারে হেপাটাইটিস?
চিত্রে
দেখা যাচ্ছে হেপাটাইটিস এ এবং বি উভয় ভাইরাসের বিপরীতে প্রতিষেধক টীকা আবিষ্কার
হয়েছে তবে আমাদের দেশে হেপাটাইটিস বি এর বিরুদ্ধে প্রতিষেধক টীকাটি বেশি প্রচলিত
এবং সরকার কর্তৃক বিনামুল্যে বাচ্চাদেরকে দেওয়া হচ্ছে। হেপাটাইটিস এ ভাইরাস দ্বারা
মূলত বাচ্চারা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। ধারণা করা হয় এই ভাইরাস নিজে যকৃতের কোষের
ক্ষতি না করলেও এই ভাইরাসের উপস্থিতিতে আমাদের নিজেদের দেহের সাইটোটক্সিক টি সেল
নামে বিশেষ প্রতিরক্ষা প্রদানকারী কোষ নিঃসৃত পদার্থই যকৃত কোষের ক্ষতির জন্য
দায়ী। অপরদিকে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হেপাটাইটিস বি ভাইরাস হেপাঅ্যাডিনো গোত্রের
অন্তর্ভুক্ত আবরণীযুক্ত ডিএনএ ভাইরাস। এই ভাইরাসকে আবিষ্কারকের নাম অনুসারে ড্যান
পার্টিকেলও বলা হয়। হেপাটাইটিস বি বাদে বাকি সকল হেপাটাইটিস ভাইরাসই আরএনএ ভাইরাস।
যদিও ক্ষতিকর প্রভাবের দিক থেকে সবচেয়ে মারাত্মক হেপাটাইটিস সি ভাইরাস সবচেয়ে বেশি
ক্ষতিকর তবে এর প্রাদুর্ভাব খুবই কম বলেই রক্ষা। জেনে রাখার মত বিষয় হল হেপাটাইটিস
বি, সি ও ডি ভাইরাস তিনটিই ক্রনিক (দীর্ঘস্থায়ী) সংক্রমণ করতে পারে। হেপাটাইটিস ডি
ভাইরাসের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এটি একা একা মানুষের দেহে প্রবেশ
করলেও একা একা রোগ তৈরি করতে পারে না। এটির রোগ
সৃষ্টির জন্য দেহে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের উপস্থিতি অবশ্যই থাকতে হবে।
হেপাটাইটিস
রোগের লক্ষণগুলো কী?
হেপাটাইটিস
রোগের রোগ লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলপ্রস্রাবের রঙ হলদে
হয়ে যাওয়া, ক্লান্তিভাব, ত্বক হলুদ
হয়ে যাওয়া, ত্বকে চুলকানো, ক্ষুধামন্দা,
হালকা জ্বর বা জ্বর-জ্বর
ভাব।
এছাড়াও
সকল প্রকার হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে প্রায়ই রোগী জন্ডিস নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান । জণ্ডিস হলে ত্বক কিংবা চোখের সাদা অংশ অতিরিক্ত বিলিরুবিনের জন্য
হলুদ হয়ে যায়। এছাড়া অতিরিক্ত বিলিরুবিনের জন্য শরীরে চুলকানিও হতে পারে। হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর অন্যতম
মারাত্মক দিক হল ভাইরাস দেহে প্রবেশের পর অনেক অনেকদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে, অপরদিকে
এটি একপ্রকার সংক্রামক রোগ হওয়াই তা দ্রুত আশেপাশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে
পারে।
কীভাবে
ছড়ায় ভাইরাসজনিত হেপাটাইটিস?
হেপাটাইটিস
এ এবং ই ভাইরাস শুধুমাত্র জীবাণুযুক্ত খাবার গ্রহনের কারনেই হতে পারে অপরদিকে
লক্ষণীয় যে হেপাটাইটিস বি, সি ও ডি রক্তের মাধ্যমে তথা সুই বা সিরিঞ্জের মাধ্যমে
কিংবা রক্ত আদান প্রদানের সময় একজন থেকে অন্য জনের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। এছাড়া একই
ব্লেড বা রেজার ব্যবহার করে শেভ করলে কিংবা আকুপাংচারের সময় বা একই সিরিঞ্জ
ব্যবহার করে মাদক গ্রহন করলেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। যাদের প্রায়ই ডায়ালাইসিস (কিডনি
বিকল রোগীদের কৃত্তিম বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন পদ্ধতি) করতে হয় তাদেরও এই
ভাইরাসগুলো দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়াও হেপাটাইটিস বি ভাইরাস
মায়ের দেহ থেকে সন্তানের দেহেও ছড়াতে সক্ষম। সাম্প্রতিক কালে যৌনমিলনের মাধ্যমে
হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ছড়ানোরও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।
হেপাটাইটিস কী খুব মারাত্মক রোগ?এর কোন চিকিৎসা আছে কী?
ভাইরাল
হেপাটাইটিসের মধ্যে হেপাটাইটিস এ শুধুমাত্র বিশ্রাম নিলেই সেরে যায়। তবে হেপাটাটিস
বি ও সি এর রোগ প্রভাব ভয়াবহ। এরা উভয়ই যকৃতের ক্যান্সার সহ লিভার ফেইলিয়র বা
লিভার সিরোসিসের মত প্রাণঘাতী রোগের সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের দেশে অনেক সময়ই
রোগীরা হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে অপচিকিৎসার শিকার হন। বিভিন্ন হার্বাল ওষুধ কোম্পানি
রাতারাতি অসুখ ভালো করে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয় বলে অনেকেই আকৃষ্ট হয়। কিন্তু মনে
রাখতে হবে দেহে প্রবেশিত ওষুধের অধিকাংশ যকৃতের মাধ্যমে দেহ থেকে অপসারিত হয় বলে
যকৃত রোগাক্রান্ত হলে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দিলে তা উল্টো যকৃতের ক্ষতিই বেশি করে।
সাধারণত রেজিস্টার্ড চিকিৎসকগন ইমুইনোগ্লোবিন বা বিভিন্ন ধরনের এন্টি ভাইরাল ওষুধ
দ্বারা ভাইরাসজনিত হেপাটাইটিসের চিকিৎসা করে থাকেন।
বাঁচতে হলে কী করবো?
ভাইরাসজনিত
হেপাটাইটিস থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায় হল প্রতিষেধক টিকা গ্রহন। আমাদের দেশে
হেপাটাইটিস বি এর টিকা হিসাবে বর্তমানে এঞ্জেরিক্স বি ও হেপা বি নামে দুইটি টিকা
প্রচলিত আছে। দেহে ভাইরাসের উপস্থিতি না থাকা সাপেক্ষে এই টিকা গ্রহন করা
যায়।ইতিমধ্যে সরকারিভাবে এই টিকা বাচ্চাদের বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে
পরিশেষ:
সমাজে
যে কোন রোগের প্রাদুর্ভাব কমানোর সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হল সতর্কতা অবলম্বন। আসুন
আমরা সবাই মিলে হেপাটাইটিসের ব্যাপারে সতর্ক হয়। পাশাপাশি সমাজে যারা ইতিমধ্যে
রোগাক্রান্ত আছেন তাদের জন্য কোন প্রকার সামাজিক বাঁধা ছাড়াই জীবন যাপনে সাহায্য
করাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এভাবেই হয়ত একদিন আমরা small pox এর ন্যায় ভাইরাল হেপাটাইটিসকেও এই বিশ্ব থেকে বিতারিত করতে পারবো।
শুভাশীষ
সাহা শুভ
রাজশাহী
চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়
তথ্যসূত্রঃ
লেখাটি হেলথ জিরো টু ইনফিনিটি নামক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত