অস্থিমজ্জা দানঃ রক্ত রোগ জয়ের এক সফল অস্ত্র

0


সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ভেবেছে কীভাবে একজন মানুষের অঙ্গ আরেক জন মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়।১৬২৮ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভে সর্বপ্রথম মানবদেহের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বর্ণনা করেন তার কিছুদিন পরেই মানুষ রক্ত প্রতিস্থাপন বা বিনিময় করতে সক্ষম হয়। সেই রক্ত বিনিময় প্রক্রিয়ার সমস্যাগুলোকে দূর করতে, একে আরও সহজ করতে কেটে গেছে অনেক অনেক বছর। বিজ্ঞানের বিকাশের ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বুঝতে শিখেছেন মানবদেহের ট্রান্সপ্লান্টেশন ইমিউনিটিকে। এখন শুধু রক্ত নয়, প্রতিস্থাপন করা সম্ভব লিভার, কিডনির ন্যায় বৃহৎ অঙ্গ।



রক্ত প্রতিস্থাপন সহজ ও নিরাপদ করার চেষ্টা করতে করতেই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন নানা রোগ যেখানে রক্ত কণিকাগুলো প্রথম থেকেই রোগাক্রান্ত হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে যেমনঃ থ্যালাসেমিয়া, সিকেল সেল অ্যানিমিয়া, লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে আরেক ধরনের রোগ যেখানে মানবদেহে প্রতিরক্ষাপ্রদানকারী কোষগুলো নিজের দেহের কোষ আর বহিরাগত পদার্থের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অটোইমিউন ডিজিস। এই দুই ধরনের রোগ চিকিৎসা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ভাবেন এর সবচেয়ে ভালো সমাধান হল রোগ যেখানে সৃষ্টি হয় সেই অস্থিমজ্জায় বদলে সেখানে সুস্থ অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন।

অস্থিমজ্জা হল আমাদের দেহের অস্থির মাঝের ফাঁকা স্থানে পাওয়া যায় এমন নরম টিস্যু। আমাদের অস্থি মজ্জাতে কিছু প্লুরিপোটেন্ট হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেল থাকে যা থেকে আমাদের দেহের সকল রক্ত কণিকাগুলো উৎপন্ন হয়। স্টেম সেল হল সেই সকল কোষ যা থেকে মানব দেহের সকল কোষ তৈরি হয়। স্টেম সেল গুলোই ধাপে ধাপে বিভেদিত হয়ে দেহের নানা কোষ তৈরি করে। যদিও আমরা অস্থি মজ্জার কোষগুলোকে স্টেম সেল বলছি কিন্তু এরা প্রকৃতপক্ষে স্টেম সেল অবস্থা থেকে কিছুটা বিভেদিত তাই এরা রক্ত কণিকা বাদে বাকি কোষ সৃষ্টি করতে পারে না।


রক্ত ও রক্ত উপাদানের ন্যায় অস্থিমজ্জাও মানুষের দেহ থেকেই সংগ্রহ করা হয়। সবচেয়ে ভালো হয় নিকট আত্মীয় যেমন ভাই বা বোনের কাছ থেকে অস্থিমজ্জা সংগ্রহ করা গেলে। ধারণা করা হয় মাত্র ৩০% লোকের পক্ষে নিজের নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে অস্থি মজ্জা নেওয়া সম্ভব। কারণ যে কারো কাছ থেকে অস্থি মজ্জা শুধু নিলেই তা প্রতিস্থাপন করা যাবে তা নয়, প্রতিস্থাপনের পূর্বে দাতা ও গ্রাহকের টিস্যু ম্যাচ করতে হবে। Human leukocyte Antigen নামে বিশেষ প্রোটিন যা শ্বেত রক্ত কণিকাতে থাকে তা প্রত্যেক মানুষের টিস্যুকে অন্যন্য করে তোলে। প্রতিস্থাপনের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতে গেলে দাতা ও গ্রহীতার টিস্যুর HLA প্রায় কাছাকাছি ধরনের হতে হয়। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে অস্থিমজ্জা দানকারীদের রেজিস্ট্রি থাকে। সেখানে প্রত্যেকের HLA Typing করে রেকর্ড রাখা হয়। কারো দরকার হলে সেই রেজিস্ট্রি থেকে আদর্শ দাতা খুঁজে নেওয়া যায়। সরকারি রেজিস্ট্রি না থাকায় নিজের আত্মীয় স্বজনের টিস্যু ম্যাচ করে কিনা তা ব্যক্তিগতভাবেও দেখে নেওয়া যায়। 



অস্থি মজ্জা দাতার যোগ্যতা অনেকটা রক্ত দাতার প্রয়োজনীয় যোগ্যতার মতই। দানকারীর বয়স ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে হওয়া উচিত। দাতাকে অস্থি মজ্জা দান করার পূর্বে অবশ্যই স্বাস্থ্য পরীক্ষা মাধ্যমে নিজেকে সংক্রমণমুক্ত প্রমাণ করতে হবে। গর্ভকালীন অবস্থা সহ প্রায় অধিকাংশ আপাত সুস্থ মানুষ অস্থিমজ্জা দান করতে পারেন। তবে ক্যান্সার বা নির্দিষ্ট কিছু হৃদরোগ থাকলে দান করা যাবে না। এছাড়াও কারো সাম্প্রতিক কালে ম্যালেরিয়া হয়ে থাকলে তাকেও অস্থিমজ্জা দান করতে বছরখানেক অপেক্ষা করতে হবে।

আগে অবশ্য অস্থিমজ্জা দানের প্রক্রিয়াটি বেশ কঠিন ছিল। বর্তমানে অস্থিমজ্জা সংগ্রহের জন্য সরাসরি অস্থি মজ্জা থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ না করে বরং রক্তস্রোতে ভাসমান স্টেমসেল সংগ্রহ করা হয়। এই পদ্ধতিকে পেরিফেরাল ব্লাড স্টেম সেল কালেকশন পদ্ধতি বলে। এই পদ্ধতিতে দাতাকে প্রথম চার দিন শ্বেতরক্ত কণিকার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য G-CSF (গ্রানালোসাইট কলোনী স্টিমুলেটিং ফ্যাক্টর) নামক হরমোন ইনজেকশন করা হয়। এটি রক্তস্রোতে ভাসমান স্টেমসেলের সংখ্যা বাড়ায়।পঞ্চমদিন রোগীর হাতের শিরা হতে রক্ত একটি অ্যাফেরেসিস মেশিনে পাঠানো হয় যা রক্ত থেকে প্রয়োজনীয় স্টেম সেল সংগ্রহ করে বাকী রক্ত দাতার দেহে পুনরায় ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এছাড়াও আরেকটি পদ্ধতি রয়েছে যা খুবই কম ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে দাতা কোমরের অস্থি থেকে সরাসরি অস্থিমজ্জা সংগ্রহ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাতাদের উল্লেখযোগ্য কোন সমস্যা হয় না। মাত্র চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে দেহ দানকৃত স্টেম সেল পুনরায় তৈরি করে নিতে পারে।

আমাদের দেশে ধীরে ধীরে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের ন্যায় জটিল চিকিৎসা পদ্ধতির ক্ষেত্রে তৈরির জন্য এখন থেকেই আমাদের রক্ত দানের ন্যায় অস্থি মজ্জা দান করার ব্যাপারে সবাইকে আগ্রহী করে তোলা প্রয়োজন। তা না হলে হয়ত চিকিৎসা শুরুর পর দাতার অভাবে চিকিৎসা প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

শুভাশীষ সাহা শুভ


তথ্যসুত্রঃ


১। http://www.nhs.uk/conditions/Bone-marrow-donation/Pages/Introduction.aspx


২।http://www.cancer.net/navigating-cancer-care/diagnosing-cancer/tests-and-procedures/donating-bone-marrow






0 comments: