ব্লাড ক্যান্সারঃ এক প্রাচীন ঘাতক
0
বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার বিবিধ উন্নতির ফলে আমরা অতীতের অনেক রোগকে
হারাতে পারলেও সেই প্রাচীন কালের ক্যান্সার নামক রোগকে আমরা কিছুতেই যেন নিজেদের
আয়ত্তে আনতে পারছি না। আমাদের শরীরের কোষগুলোও ঠিক আমাদের মত করেই ভাবে। যখন কোষের
চারপাশের পরিবেশে এটির বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে তখন এটি নিজের গাঠনিক
বৈশিষ্ট্যকে বদলে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে কিন্তু এই চেষ্টা করতে গিয়েই অনেক সময়
সৃষ্টি হয় বিপত্তি; নিয়ন্ত্রনহীন কোষ বিভাজনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় টিউমার বা
নিওপ্লাজম যা এক প্রকার অনিয়ত্রিত কোষগুচ্ছ। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেহে প্রতিদিন
এমন অসংখ্য কোষ তৈরি হয় কিন্তু তা গুচ্ছ সৃষ্টির আগেই নানা প্রক্রিয়াতে ধবংস হয়ে
যায়, তবে দুর্ভাগ্যক্রমে যদি টিকে যায় তাহলেই সমস্যার শুরু। এরকম একটি কোষ গুচ্ছ
যদি টিকে যায় তবে তার ভবিষ্যৎ দু রকম হতে পারে। প্রথমত এটি যে অবস্থায় আছে সেভাবেই
থেকে যেতে পারে কোষের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য গাঠনিক পরিবর্তন না করে। দ্বিতীয়ত এটি
আকারে বড় হতে পারে, কোষের গঠনগত মৌলিক পরিবর্তন যেমন নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজমের
ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে এবং এই কোষগুলো নিজেদের ভিত্তিপর্দা ভেদ করে আশেপাশের
কোষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রথম ধরনের কোষগুলো বিনাইন ও দ্বিতীয় ধরনের
কোষগুলোকে ম্যালিগনেন্ট নিওপ্লাজম বা ক্যান্সার বলে।
দেহের প্রায় হাতে গোনা দু-একটি অঙ্গ বাদে সকল অঙ্গেই টিউমার সৃষ্টি হতে পারে এবং তা ম্যালিগনেন্ট রূপ ধারণ করতে পারে। অন্যান্য সকল অঙ্গের ন্যায় রক্ত কনিকাগুলোতেও ক্যান্সার হতে পারে। রক্তকণিকাগুলোর মধ্যে শ্বেতরক্তকনিকাগুলোই মুলত ক্যান্সার আক্রান্ত হয়। শ্বেত রক্তকণিকা অস্থিমজ্জাতে উপস্থিত প্লুরিপোটেন্ট হেমাটোপয়েটিক সেল হতে নানা ধাপের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। আরেকটি মজার বিষয় হল প্লুরিপোটেন্ট হেমাটোপয়েটিক সেল নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টি করার মাধ্যমে সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে। ফলে সাধারণ অবস্থায় যতই রক্তকণিকা তৈরি হোক না কেন প্লুরিপোটেন্ট হেমাটোপয়েটিক সেলের সংখ্যা কমে না।
রক্তকণিকাগুলোর নিওপ্লাজমগুলোকে তাদের
নানা বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে আরও সুক্ষভাবে শ্রেণীবিভাগ করা হয়। যেমন লিম্ফয়েড নিওপ্লাজমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বড় গ্রুপ নন
হজকিন লিম্ফোমাকে WHO চিত্রের
বর্ণনার ন্যায় ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করেছে।এতে খুব সহজেই অনুমান করা যায় রক্তের
বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সারের মধ্যে ভিন্নতা প্রচুর বেশি। অর্থাৎ এদের চিকিৎসা
পদ্ধতির মধ্যেও পার্থক্য অনেক। এদের মধ্যে কিছু ক্যান্সারের আরোগ্য হার বেশি
কোনটির আবার অনেক কম। সাধারণত এই ক্যান্সারগুলো প্রকৃতি, গ্রেডিং ও স্টেজিং এর উপর
নির্ভর করে চিকিৎসক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করেন। চিকিৎসা হিসাবে সাধারণত
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ভিত্তিক কেমোথেরাপি ও বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লাট সবচেয়ে বেশি
ব্যবহৃত হয়।
সতর্কতাঃ
অন্যান্য যেকোন ক্যান্সারের ন্যায় ব্লাড ক্যান্সারও যত দ্রুত নির্নয় করা
যাবে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা তত বাড়বে। আমাদের দেহে প্রতিরক্ষা দেবার কাজ
শ্বেতরক্তকণিকা করে বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণগুলো প্রতিরক্ষা
ব্যবস্থার সাথেই সম্পর্কিত হয়ে থাকে। বার বার বিভিন্ন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ইনফেকশন এ আক্রান্ত হওয়া ব্লাড ক্যান্সারের একটি অন্যতম লক্ষন। এছাড়াও অন্যান্য প্রধান লক্ষণ
গুলোর মধ্যে রয়েছে রক্তশূন্যতা, দাঁতের মাড়ি বা অন্যান্য স্থানে রক্ত ক্ষরণ, জ্বর, লসিকাগ্রন্থি ও প্লীহা
ফুলে যাওয়া সহ নানা সমস্যা।
লোহিত
রক্ত কণিকা সৃষ্টি ও পূর্ণতা প্রাপ্তির
প্রক্রিয়াতেও বাঁধা সৃষ্টি হয় বলে ব্লাড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রক্তশুন্যতা দেখা
দেয়। সেক্ষেত্রে ফ্যাকাসে ভাব, শারীরিক দুরবলতা,অল্পতে হাঁপিয়ে
ওঠা এসব লক্ষণও থাকে। এছাড়াও একই কারণে অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যাবার ফলে অধিক রক্ত ক্ষরণ, দীর্ঘক্ষণ ধরে রক্তক্ষরণ, নাক বা দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ার প্রবণতা দেখা
দিতে পারে। এছাড়া অত্যাধিক পরিমাণে
শ্বেতরক্তকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধিও ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষন। আরও অন্যান্য লক্ষণের মাঝে আছে-হাড় বা জয়েন্টে ব্যাথা হওয়া, লসিকা গ্রন্থি
ফুলে যাওয়া, অতিরিক্ত
অবসন্নতা, ক্ষুধামন্দা, ঘন ঘন জ্বর হওয়া, পেটে ব্যাথা হওয়া ইত্যাদি।
চিকিৎসাঃ
বাংলাদেশে ইতিমধ্যে
রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। দেশের সকল হাসপাতালে এধরনের জটিল
রোগের চিকিৎসা দেবার মত অবকাঠামো গড়ে না উঠলেও কিছু বিশেষায়িত সেন্টার রয়েছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে শিশুদের মাঝে রক্তের ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে
বেশি বাড়ছে। তাদের চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে
রয়েছে ৩১ বেডের দুইটি ইউনিট। এখানে চিকিৎসার খরচ বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশের
তুলনায় খুবই কম। বাচ্চাদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এমন ক্যান্সারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
Acute Lymphoblast
Leukemia (ALL) এবং Acute Myeloid Leukemia (AML) এর
চিকিৎসা খরচ এখানে যথাক্রমে প্রায় ৩ লাখ ও ৫ লাখ টাকার মত। এছাড়াও ঢাকা মেডিকেল
কলেজে একটি বিশেষায়িত ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।
শুভাশীষ
সাহা শুভ
তথ্যসূত্রঃ
১। Robbins & Cotran Pathologic Basis of Disease, 9e (Robbins
Pathology)by Vinay Kumar, Abul K. Abbas, Jon C. Aster (8th Edition)
Page: 444- 468
২। Current Medical Diagnosis and Treatment, 2014
page: 511-531