চিকিৎসা ক্ষেত্রে গত বছরের সেরা দশটি আবিষ্কার
0
বিগত বছর আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসের জন্য ছিল
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত বছরের অনেকগুলো আবিষ্কার বদলে দিয়েছে চিকিৎসা সেবার
মান। এ পর্বের লেখা বিগত বছরের সেরা ১০টি আবিষ্কার নিয়ে।
১০। ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন ওষুধ:
মরনব্যাধি ক্যান্সার চিকিৎসায় আরও একটি মাইলফলক উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের দেহকে প্রতিরক্ষা প্রদানের জন্য B lymphocyte অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ক্রোনিক ল্যিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া নামক রোগে আক্রান্ত
মানুষের ক্ষেত্রে এই কোষ ক্যান্সার কোষে পরিনত হয়। প্রতিবছর শুধু আমেরিকাতেই প্রায়
৪৪০০ জন মানুষ এ রোগে মারা যান। কিন্তু এখন এই রোগ চিকিৎসায় নতুন দ্বার উন্মোচিত
হয়েছে। Ibrutinib নামে
ব্রুটন’স
টাইরোসিন কাইনেজ ইনহিবিটর গ্রুপের ওষুধ এই রোগ চিকিৎসায় অত্যন্ত ভালো সাফল্য
প্রদর্শন করেছে। বর্তমানে ক্রোনিক ল্যিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া ছাড়াও এই ওষুধ ম্যান্টেল
সেল লিম্ফোমা( রক্তকোষের ক্যান্সার) ও ওলডেনস্ট্রোম’স মাক্রোগ্লোবুনেমিয়া রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
৯। পেট দেখে
হৃদরোগ নির্ণয়:
সারা বিশ্বব্যাপী হৃদরোগ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা অবস্থায়
নির্ণয়ের জন্য সহজ পদ্ধতি নির্ণয়ের চেস্টা চলছে। ২০১৩ সালে একদল বিজ্ঞানী Trimethylamine
N-Oxide (TMAO) নামে হৃদরোগ নির্ণয়ের জন্য
বায়োমার্কার প্রস্তাব করেন। কোলিন হল এক প্রকার রাসায়নিক বস্তু যা ডিমের কুসুম, গরুর
মাংস ও দুধ জাতীয় খাদ্যে পাওয়া যায়। কোলিন রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট করে দেয়
ফলে রক্তনালী ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনা বাড়ে। পেটের পরিপাক নালীতে থাকা ব্যাকটেরিয়া এই
কোলিনকে পরিপাক করে TMAO উৎপন্ন করে। New England Journal of Medicine এ প্রকাশিত রিপোর্ট হতে জানা যায় ৪০০০ লোকের উপর তিন বছর ধরে করা গবেষণায় দেখা
গেছে রক্তে অতিরিক্ত TMAO মাত্রা
সার্থক ভাবে হৃদরোগের সম্ভাবনা প্রকাশ করে।
৮। ব্যক্তিগত
ঘুমপাড়ানি যন্ত্র:
বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য ছোটখাটো অস্ত্রোপচার কিংবা পরীক্ষার
জন্য অবশ করার ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধ রোগীর শরীরে প্রবেশ করানোর জন্য দরকার
হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের। ফলে সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। SEDASYS System নামে
নতুন যন্ত্র খুব অনায়াসেই এ কাজটি করতে পারে। যন্ত্রটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত হয়ে Propofol নামে চেতনানাশক ওষুধ শিরাপথে রোগীর দেহে প্রবেশ করাতে পারে। এছাড়াও এই যন্ত্রে
রোগীর চেতনার মাত্রা নিয়ত্রনও করা যায়। এতে অপারেশন চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে রোগীর
সামগ্রিক অবস্থা দেখার ব্যবস্থাও রয়েছে। আপাতত এ যন্ত্রটি FDA
কতৃক শুধুমাত্র কোলোনোস্কপির (পরিপাক নালি দেখার পরীক্ষার) জন্য অনুমোদিত।
৭। হার্ট
ফেইলর চিকিৎসায় নতুন দিগন্তঃ
হার্ট ফেইলর একটি জীবনঘাতী রোগ। এ রোগ রোগীর জীবনের মান ও বেঁচে থাকার সময়কাল
উভয়ই কমায়। প্রতিবছর যে পরিমাণ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হন উন্নত ওষুধ ও যন্ত্র
ব্যবহারের ফলেও তার প্রায় অর্ধেক মানুষ পাঁচ বছরের বেশি বাঁচেন না এবং প্রায় ২৫% রোগী
প্রথম বছরের মধ্যেই মারা যান। এমতাবস্থায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের হাতে আসছে নতুন অস্ত্র
সেরেলেক্সিন (Serelaxin) যা এ রোগের লক্ষণ ও এ রোগের ফলে
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচায়। এটি রিলাক্সিন-২ নামে একটি
হরমোনের সিনথেটিক রূপ। এটি দেহে উৎপন্ন রিলাক্সিন-২ এর মত কাজ করে যা রক্তনালীগুলোকে সম্প্রসারিত করে রক্ত প্রবাহকে উন্নত করে।
এটি প্রদাহ সৃষ্টিতে বাঁধাদানকারী(anti-inflammatory) হিসাবেও
কাজ করে যা যকৃত, বৃক্ক ও হৃৎপিণ্ড কে হার্ট ফেইলর জনিত ক্ষতির হাত থেকেও রক্ষা করে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা
গেছে এটি হার্ট ফেইলর জনিত মৃত্যুর হার প্রায় ৩৮ % কমিয়ে আনে। হার্ট ফেইলরের বিপরীতে গত দুই দশকে
আবিষ্কৃত এটিই সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ।
৬। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া ট্রান্সপ্লান্ট:
আমাদের
অন্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়া আমাদের দেহের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার সহ নানা কারণে এই ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হতে
পারে যা পরবর্তীতে inflammatory Bowel Disease সহ নানা রোগের কারণ হয়। বিজ্ঞানীরা সে সব রোগ প্রতিরোধ করতে সুস্থ
ব্যক্তির বর্জ্য পদার্থ হতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া আলাদা করার পদ্ধতি বের করেছেন এবং
তা সার্থকভাবে অন্যের দেহে প্রতিস্থাপনও করেছেন।
৫। নতুন অবেদন সিস্টেম:
অতি প্রাচীন কালে বিভিন্ন সার্জারির সময় অ্যানেসথেসিয়া
বা অবেদন করার পর রোগীকে মনিটর করার প্রক্রিয়া ছিল অনেকটাই সাধারণ । কিন্তু
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে অবেদন প্রক্রিয়া যেমন উন্নত হয়েছে তেমনি কঠিন ও জটিল
অপারেশনের জন্য দরকার হয়ে পড়েছে উন্নত অবেদন ব্যবস্থা। একদল পারদর্শী অবেদনবিদের
আবিষ্কৃত নতুন এই সিস্টেম উন্নত কম্পিউটার
প্রযুক্তি ও মাইক্রোইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্র ব্যবহার করে অবেদন করার আগে, অস্ত্রোপচারের
সময় এবং তারপরের সকল ঘটনা, ব্যবহৃত ঔষধ ও অপারেশনের বর্ণনাসহ
সমস্ত তথ্য রেকর্ড করে রাখতে পারে। অপারেশন চলাকালীন সময়ে রোগীর অবস্থা সাথে সাথেই
এই যন্ত্র জানিয়ে দিতে পারে বলে তা চিকিৎসকদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে এবং ভুলের
পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারে। এই যন্ত্রের একটি অংশ রোগীর হার্ট রেট, রক্তচাপ, নিঃশ্বাসের হার ইত্যাদি তাৎক্ষণিক ভাবে সংগ্রহ করে এবং মনিটরে প্রদর্শন করে।
আরেকটি অংশ যা ডিসিশন সাপোর্ট সিস্টেম নামে পরিচিত তা বিভিন্ন তত্থ্য জটিল অ্যালগরিদমের
মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে উপস্থাপন করে এবং অস্ত্রোপচার কিংবা অস্ত্রোপচার
পরবর্তী যে কোন সময়ে চিকিৎসককে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
৪। হেপাটাইটিস সি চিকিৎসায় নতুন দৃষ্টান্ত:
হেপাটাইটিস সি একটি ভাইরাস জনিত প্রাণঘাতী রোগ। এ রোগের
প্রচলিত চিকিৎসায় যাদের উন্নতি হতো না ২০১১ সালের আগে পর্যন্ত তাদের জন্য ভিন্ন
কোন ওষুধ ছিল না। ২০১১ সালে সর্বপ্রথম Telaprevir ও Boceprevir নামক দুইটি প্রোটিয়েজ ইনহিবিটর গ্রুপের দুইটি ওষুধ আসে যা
ইতিমধ্যেই অনেক হেপাটাইটিস রোগীর জীবন বাঁচিয়েছে। গতবছর এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে
নতুন ওষুধ যার নাম Sofosbuvir যা একটি
নিউক্লিওটাইড অ্যানালগ। এটি ribavirin নামক ওষুধের সাথে ট্যাবলেট আকারে HCV genotypes 2 and
3 এর জন্য এবং pegylated interferon এবং ribavirin এর সাথে HCV genotypes 1 and 4 এর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
৩। খিঁচুনি
বন্ধের নতুন যন্ত্র:
এপিলেপসি বা মৃগী
রোগীদের জন্য খিঁচুনি একটি মারাত্মক সমস্যা। এ সমস্যার ফলে রোগী স্বাভাবিক
জীবনযাপন করতে পারে না। সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কৃত রেস্পন্সিভ নিউরো স্টিমুলেশন
সিস্টেম এই খিঁচুনি বন্ধ করতে পারে। যে সকল রোগীর ক্ষেত্রে প্রচলিত
ওষুধ দ্বারা খিঁচুনি বন্ধ করা যায় না তাদের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা যায়। মাথায়
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এই ব্যাটারি চালিত ছোট্ট যন্ত্রটিকে স্থাপন করা হয়। এতে Cortical Strip Leads এবং
Depth Leads নামে দুইটি EEG (electroencephalogram)
লিড থাকে যা প্রতিনিয়ত রোগীর ব্রেন কে
মনিটর করতে থাকে, কোন খিঁচুনির লক্ষন দেখা
মাত্র এই যন্ত্র তা বন্ধ করতে নিউরো স্টিমুলেশন প্রদান করে। যন্ত্র যে EEG রেকর্ড করে তা একটি সুরক্ষিত Patient Data
Management System (PDMS) এ রক্ষিত থাকে
যা চাহিদা মাত্র দেখা সম্ভব। এছাড়া এই যন্ত্রে একটি বিশেষ ম্যাগনেট ও দেওয়া হয় যার
মাধ্যমে রোগী তার সুবিধাজনক সময়ে EEG শুরু কিংবা নিউরোস্টিমুলেশন দেওয়া বন্ধ করতে পারেন।
২। ক্যান্সার চিকিৎসায় জিনোমিক টেস্টের ব্যবহারঃ
গত বছর হতে
বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসায় জিনোমিক টেস্টের পরিমাণ উল্লেখ যোগ্য হারে বেড়ে
গেছে। ক্যান্সার চিকিসায় ব্যবহৃত অনেক ওষুধই উপকারের তুলনায় ক্ষতি বেশি করতে পারে
তাই চিকিৎসকেরা এখন জিনোমিক টেস্টের উপর নির্ভর করছেন। এ ধরনের টেস্টের ক্ষেত্রে
টিউমার কোষ হতে ডিএনএ সংগ্রহ করে তার উপর উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্বাচন
করা হয়। এছাড়াও এই সকল টেস্টের মাধ্যমে
টিউমার অপসারণের পরে তার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনাও জানা যায়। এতে ক্যান্সার চিকিৎসায়
এক নতুন যুগের সৃষ্টি হয়েছে।
১। কৃত্তিম চোখের স্বপ্ন বাস্তব হলঃ
গতবছরের
পূর্বে Retinitis
Pigmentosa কিংবা atrophic
macular degeneration
রোগের কোন কার্যকর চিকিৎসা
ছিল না। এ রোগ আক্রান্তরা ৪০ বছর বয়সের মধ্যে অন্ধ হয়ে যেত। এই রোগ আক্রান্তদের
রেটিনায় থাকা রড ও কোণ কোষ নষ্ট হয়ে যেত যা স্বাভাবিক মানুষকে দেখতে সাহায্য করে।
এই কোষদ্বয় চোখের লেন্সে প্রতিসরিত আলোকে ইলেক্ট্রোক্যামিকেল উদ্দীপনায় পরিনত করে
এবং অপটিক নার্ভে পাঠিয়ে দেয় ফলে আমরা দেখতে পায়। এই রোগের সমাধান হিসাবে আবিষ্কৃত
নতুন কৃত্তিম চোখে একটি retinal prosthesis আছে যা চোখে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্থাপন করা হয় একটি video camera যুক্ত
চশমা ও হাতে বেঁধে রাখার উপযোগী ভিডিও প্রসেসিং ইউনিট আছে।
এই যন্ত্র চোখের দৃষ্টি শক্তি সম্পূর্ণ ফেরত আনতে পারে না
তবে এটি মানুষকে আলো ও অন্ধকার উভয় মাধ্যমে পরিবেশ, মানুষ এবং বড় আকৃতির বস্তু চেনাতে
পারে।
তথ্যসূত্রঃ
৫।http://health.clevelandclinic.org/2013/10/no-6-innovation-fecal-transplantation-fights-disease-video/
৬।http://health.clevelandclinic.org/2013/10/no-5-innovation-a-support-system-for-surgery-video/
৮। http://www.reviewofophthalmology.com/content/d/retina/c/39759/
৯। http://health.clevelandclinic.org/2014/01/top-10-medical-innovations-for-2014/
-শুভাশীষ সাহা শুভ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ