থ্যালিডোমাইডঃ চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক কলঙ্কময় অধ্যায়
0
বিজ্ঞানের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে নিরাপদ রাখা, সুস্থ রাখা। বিভিন্ন সময়ে আবিষ্কৃত নানা জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বিজ্ঞানের এক অন্যতম উপকারী দিক। এই আধুনিক বিজ্ঞান যুগে আসতে আসতে ওষুধ আবিষ্কার ও ওষুধের ফলাফল যাচাই করার প্রক্রিয়া অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে। মানুষ তার দীর্ঘদিনের ইতিহাস থেকে শিখেছে কোনো ওষুধ বাজারে ছাড়ার আগে এর একটি সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাবও অজানা রাখা যাবে না কেননা যদি কোন ক্ষতিকর প্রভাব ওষুধ বাজারজাত করার পরে জানা যায় তবে তা উপকারের বদলে মানব জাতির জন্য একরকম বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে। থ্যালিডোমাইড, রোফিক্সিব ইত্যাদি ওষুধগুলোর ইতিহাস বারবার আমাদের ওষুধ তৈরি প্রক্রিয়াতে আরও বেশি সতর্ক হবার কথা মনে করিয়ে দেয়।


সমস্ত সমাজের জন্য দুঃখের বিষয় এই যে গর্ভবতী মায়েদের থ্যালিডোমাইড ব্যবহার ছিল এক মারাত্মক ভুল। তৎকালীন সময়ে কেউ এটা জানতো না যে গর্ভকালীন ৩৫ থেকে ৪৮ দিনের মধ্যে ফিটাস থ্যালিডোমাইডের সংস্পর্শে আসলে ২০-৩০% বাচ্চার হাত-পা ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গের মারাত্মক বিকৃতি হতে পারে। ১৯৫০ এর দিকে বিজ্ঞান এতটাই পিছিয়ে ছিল যে আমরা জানতামই না মায়ের দেহে প্রয়োগকৃত ওষুধ অমরা ভেদ করে বাচ্চার দেহে প্রবেশ করতে পারে এবং ক্ষতি করতে পারে ফলে থ্যালিডোমাইড গর্ভবতী প্রাণীর উপর পরীক্ষা করে দেখা হয় নি। বেশ কয়েকবছর সময় লেগে যায় এই কুপ্রভাব বুঝতে।
যে সব গর্ভবতী মহিলা এই ওষুধ খেয়েছিলেন, তাদের বাচ্চারা ফকোম্যালিয়া নামে এক বিকাশ বিকৃতিজনিত রোগ নিয়ে জন্ম নেয় ৷ফ্রান্সের অ্যানাটমিস্ট Étienne Geoffroy Saint-Hilaire সর্বপ্রথম ১৮৩৬ সালে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন এবং তারপর এটি ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেলেও আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে হঠাৎ থ্যালিডোমাইডের কারণে আলোচনায় আসে। এই রোগে হাত-পায়ের বড় অস্থির গঠন বাধাগ্রস্থ হয়, ফলে হাত-পা অস্বাভাবিক রকমের ছোট হয় এবং আঙ্গুল, কান ও অন্ত্রের বিকাশও বাধাগ্রস্থ হয়৷জার্মানির ওষুধের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ছিল এটি৷ একে এককথায় কন্টারগান কেলেঙ্কারি বলা হয়৷ বহু বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয় কন্টারগান বা থালিডোমাইড ওষুধের কারণে৷অবশেষে ১৯৬১ সালের ২৭ নভেম্বর এই ওষুধকে বাজার থেকে তুলে নেয়া হয় কিন্তু ইতিমধ্যে এক বিশাল সর্বনাশ হয়ে যায়। বিশ্বের দশ হাজার শিশু থ্যালিডোমাইডের শিকার হয়ে


ইতিমধ্যে ১৯৬৪ সালে ইজরায়েলি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে থ্যালিডোমাইড কুষ্ঠরোগের ওষুধ হিসাবে কাজ করতে পারে। ১৯৯৮ সালের দিকে আমেরিকান এফডিএ পুনরায় এই ওষুধকে মাল্টিপল মাইলোমা নামক রক্ত কোষের ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য অনুমোদন দেয়। এছাড়া থ্যালিডোমাইড এইডস ও ক্রনস ডিসিজ নামক রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যায় কিনা সে ব্যাপারে গবেষণা চলছে। আফ্রিকাতে এখনও অনেক নারী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থ্যালিডোমাইড গ্রহন করেন ।
সবশেষে সান্ত্বনা এতটুকুই যে জার্মানিতে থ্যালিডোমাইড দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তরা গ্র্যুনেনথাল কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করায় কোম্পানিটি ১৯৭০ সালে একটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কিছু ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়৷ পরে সরকারও এই ফাউন্ডেশনে ১৬০ মিলিয়ন ইউরো সহায়তা হিসাবে দেয়৷ ফলে ভুক্তভুগীরা বর্তমানে মাসে মাত্র ১১০০ ইউরোর মতো ভাতা পান৷
তথ্যসূত্রঃ
১। http://www.nytimes.com/2010/03/16/science/16limb.html?_r=0
২। http://en.wikipedia.org/wiki/Phocomelia
৩। https://english.tau.ac.il/impact/thalidomide
৪। http://www.thalidomide.ca/thalidomide-did-not-cause-all-birth-defects/
৫। http://en.wikipedia.org/wiki/Gr%C3%BCnenthal_GmbH