থ্যালিডোমাইডঃ চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক কলঙ্কময় অধ্যায়

0


বিজ্ঞানের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে নিরাপদ রাখা, সুস্থ রাখা। বিভিন্ন সময়ে আবিষ্কৃত নানা জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বিজ্ঞানের এক অন্যতম উপকারী দিক। এই আধুনিক বিজ্ঞান যুগে আসতে আসতে ওষুধ আবিষ্কার ও ওষুধের ফলাফল যাচাই করার প্রক্রিয়া অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে। মানুষ তার দীর্ঘদিনের ইতিহাস থেকে শিখেছে কোনো ওষুধ বাজারে ছাড়ার আগে এর একটি সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাবও অজানা রাখা যাবে না কেননা যদি কোন ক্ষতিকর প্রভাব ওষুধ বাজারজাত করার পরে জানা যায় তবে তা উপকারের বদলে মানব জাতির জন্য একরকম বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে। থ্যালিডোমাইড, রোফিক্সিব ইত্যাদি ওষুধগুলোর ইতিহাস বারবার আমাদের ওষুধ তৈরি প্রক্রিয়াতে আরও বেশি সতর্ক হবার কথা মনে করিয়ে দেয়।


থ্যালিডোমাইড নামক ওষুধ নিয়ে ঘটনাটির শুরু জার্মানিতে। এর আবিষ্কারক জার্মান কোম্পানীর নাম Chemie Grunenthal। এটি সেই কোম্পানি যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে সর্বপ্রথম পেনিসিলিন নামক অ্যান্টিবায়োটিক বাজারজাত করে এবং অনেক মানুষের জীবন বাঁচায়। ১৯৫৪ সালে সেই একই কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে থ্যালিডোমাইড নামে এক নতুন ওষুধ। এই ওষুধ বাজারজাত করার আগে কেউ জানতো না কী সর্বনাশটাই না ঘটতে যাচ্ছে। ১৯৫৪ সালে ২০ বছরের প্যাটেন্ট পাবার পর তারা Grippex নামে শ্বাসনালীর ইনফেকশনজনিত রোগের ওষুধ হিসাবে থ্যালিডোমাইড বাজারজাত করা শুরু করে। এই ওষুধে থ্যালিডোমাইডের পাশাপাশি কুইনিন, ভিটামিন সি, ফেনাসিটিন এবং অ্যাসিটাস্যালিসাইলিক এসিড ছিল। পরবর্তীতে দেখা যায় আলাদাভাবে এটি ঘুমের ওষুধ হিসাবেও অনেক বেশি কার্যকর। তৎকালীন সময়ে ঘুমের ওষুধ হিসাবে মূলত বারবিচুরেট জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হত যা অধিক মাত্রায় গ্রহন করলে মৃত্যু হত, অপরদিকে থ্যালিডোমাইড অনেক বেশি সহনশীল ছিল এবং অধিক মাত্রায় গ্রহনেও কোন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ছিল না ফলে তা খুব দ্রুত মানুষের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি ব্যবহারে তখন তেমন কোন ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া না পাওয়া যাওয়ায় এটি প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ফার্মেসীর দোকানে পাওয়া যেত। অস্ট্রেলিয়ান প্রসূতিবিদ ড. উইলিয়াম মাকব্রাইড পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ধারণা করেন, গর্ভবতী নারীদের অস্বস্তি দূর করার ক্ষেত্রে থ্যালিডোমাইড ভালো কাজ করবে৷এরপর থেকে বিশ্বব্যাপী গর্ভবতী মায়েদের গর্ভকালীন বমিবমি ভাব, অনিদ্রা ও ব্যাথা দূর করার জন্য ওষুধটি ব্যবহৃত হতে থাকে৷ এ সময় গ্র্যুনেনথাল গ্রুপ কন্টারগান নামে ওষুধটি বাজারজাত করে।

সমস্ত সমাজের জন্য দুঃখের বিষয় এই যে গর্ভবতী মায়েদের থ্যালিডোমাইড ব্যবহার ছিল এক মারাত্মক ভুল। তৎকালীন সময়ে কেউ এটা জানতো না যে গর্ভকালীন ৩৫ থেকে ৪৮ দিনের মধ্যে ফিটাস থ্যালিডোমাইডের সংস্পর্শে আসলে ২০-৩০% বাচ্চার হাত-পা ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গের মারাত্মক বিকৃতি হতে পারে। ১৯৫০ এর দিকে বিজ্ঞান এতটাই পিছিয়ে ছিল যে আমরা জানতামই না মায়ের দেহে প্রয়োগকৃত ওষুধ অমরা ভেদ করে বাচ্চার দেহে প্রবেশ করতে পারে এবং ক্ষতি করতে পারে ফলে থ্যালিডোমাইড গর্ভবতী প্রাণীর উপর পরীক্ষা করে দেখা হয় নি। বেশ কয়েকবছর সময় লেগে যায় এই কুপ্রভাব বুঝতে।



যে সব গর্ভবতী মহিলা এই ওষুধ খেয়েছিলেন, তাদের বাচ্চারা ফকোম্যালিয়া নামে এক বিকাশ বিকৃতিজনিত রোগ নিয়ে জন্ম নেয় ৷ফ্রান্সের অ্যানাটমিস্ট Étienne Geoffroy Saint-Hilaire সর্বপ্রথম ১৮৩৬ সালে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন এবং তারপর এটি ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেলেও আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে হঠাৎ থ্যালিডোমাইডের কারণে আলোচনায় আসে। এই রোগে হাত-পায়ের বড় অস্থির গঠন বাধাগ্রস্থ হয়, ফলে হাত-পা অস্বাভাবিক রকমের ছোট হয় এবং আঙ্গুল, কান ও অন্ত্রের বিকাশও বাধাগ্রস্থ হয়৷জার্মানির ওষুধের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ছিল এটি৷ একে এককথায় কন্টারগান কেলেঙ্কারি বলা হয়৷ বহু বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয় কন্টারগান বা থালিডোমাইড ওষুধের কারণে৷অবশেষে ১৯৬১ সালের ২৭ নভেম্বর এই ওষুধকে বাজার থেকে তুলে নেয়া হয় কিন্তু ইতিমধ্যে এক বিশাল সর্বনাশ হয়ে যায়। বিশ্বের দশ হাজার শিশু থ্যালিডোমাইডের শিকার হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয় যার প্রায় ৪০% শিশু প্রথম বছর পূর্ণ করার আগেই মারা যায়।


হয়ত থ্যালিডোমাইড নিয়ে ঘটনাপ্রবাহ এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্তু হয়নি। সেই ১৯৫০ সালের পরে প্রায় পাঁচ দশক কেটে গেছে কিন্তু ভ্রুন বিকাশ বিশেষজ্ঞগন কিছুতেই খুঁজে পান নি কী করে থ্যালিডোমাইড এই বিকাশজনিত বিকৃতি ঘটিয়েছিল। ১৯৬০ সালের দিকে ভ্রুন বিকাশ বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রানীর ভ্রুনে থ্যালিডোমাইড ইনজেকশন দিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এসকল গবেষণা থেকে প্রায় ৩০ টির মত সম্ভাব্য তত্ত্ব সামনে আসে। কেউ বলেন থ্যালিডোমাইড বিকাশমান ভ্রুনের স্নায়ুকে নষ্ট করে, কেউ বলেন এটি বিকাশমান হাত পায়ের কোষগুলোকে নষ্ট করে দেয়, আবার কেউ কেউ বিকাশমান ভ্রুনের ডিএনএতে পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়াকে বাধা দানের কথা বলেন। দুঃখের বিষয় এই তত্তের কোনটি নিয়েই শেষ পর্যন্ত গবেষণা করে ফলাফলে পৌঁছানো যায় নি। বিজ্ঞানীদের কাছে কিভাবে হাত-পা তৈরি হয় তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে বটে কিন্তু থ্যালিডোমাইড ব্যবহারের ফলে সংঘটিত রাসায়নিক পরিবর্তনগুলোযে ঠিক কিভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে তা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। আরো একটি সমস্যা হল যখন একজন মানুষ থ্যালিডোমাইড ট্যাবলেট গ্রহন করেন তখন তা দেহের এনজাইমগুলো দ্বারা ভেঙ্গে ১৮ টি ভিন্ন যৌগের যে কোনটিতে পরিনত হতে পারে যার প্রত্যেকটির আনবিক গঠন ও কোষের সাথে মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়া ভিন্ন। Dr. Vargesson নামে একজন বিজ্ঞানী সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কার করেন থ্যালিডোমাইড হতে উৎপন্ন CPS49 যৌগই মূলত এই অঙ্গ বিকৃতির জন্য দায়ী, আপাত দৃষ্টিতে এটিই উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব।এটি সহ বাকি তত্ত্বগুলোও গবেষণাধীন।

ইতিমধ্যে ১৯৬৪ সালে ইজরায়েলি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে থ্যালিডোমাইড কুষ্ঠরোগের ওষুধ হিসাবে কাজ করতে পারে। ১৯৯৮ সালের দিকে আমেরিকান এফডিএ পুনরায় এই ওষুধকে মাল্টিপল মাইলোমা নামক রক্ত কোষের ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য অনুমোদন দেয়। এছাড়া থ্যালিডোমাইড এইডস ও ক্রনস ডিসিজ নামক রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যায় কিনা সে ব্যাপারে গবেষণা চলছে। আফ্রিকাতে এখনও অনেক নারী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থ্যালিডোমাইড গ্রহন করেন ।

সবশেষে সান্ত্বনা এতটুকুই যে জার্মানিতে থ্যালিডোমাইড দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তরা গ্র্যুনেনথাল কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করায় কোম্পানিটি ১৯৭০ সালে একটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কিছু ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়৷ পরে সরকারও এই ফাউন্ডেশনে ১৬০ মিলিয়ন ইউরো সহায়তা হিসাবে দেয়৷ ফলে ভুক্তভুগীরা বর্তমানে মাসে মাত্র ১১০০ ইউরোর মতো ভাতা পান৷


তথ্যসূত্রঃ

১। http://www.nytimes.com/2010/03/16/science/16limb.html?_r=0

২। http://en.wikipedia.org/wiki/Phocomelia

৩। https://english.tau.ac.il/impact/thalidomide

৪। http://www.thalidomide.ca/thalidomide-did-not-cause-all-birth-defects/



৫। http://en.wikipedia.org/wiki/Gr%C3%BCnenthal_GmbH

0 comments: