sin, tan , sec ত্রিকোণমিতির এই নামগুলো কোথা থেকে এল?

0
সাইন, ট্যান, সেক-তোমাদের মধ্যে ত্রিকোণমিতির সামান্য জ্ঞান যাদের আছে, তারা সবাই এই নামগুলো চেন। কিন্তু এই নামগুলো কোত্থেকে এল, সেটা কি জানো?  কদিন আগে একটা দারুণ বই পড়ছিলাম ‘Great moments in mathematics before 1650’। সেখানে খুব সুন্দর করে sin এর গল্পটা বলা ছিল। উইকিপিডিয়া ঘেঁটে আরও কিছু শিখলাম। ভাবলাম যা জেনেছি, তোমাদের সাথে ভাগ করে নিই। সে জন্যেই এই লেখা। চলো আগে নামগুলোর আভিধানিক অর্থ জেনে নিই। এই আভিধানিক অর্থ আমি আগেও জানতাম, কিন্তু সেই জানাটাই আসলে আমাকে আরও দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিল!

sine (সংক্ষেপে আমরা লিখি sin)শব্দটা এসেছে ল্যাটিন sinus থেকে, যার মানে হলো গর্ত বা গহ্বর ! নাকের গহ্বরে প্রদাহ হলে তাকে sinusitis বলে, তখন প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়। তোমরা হয়তো তার কথা শুনেও থাকতে পার। tangent(যাকে সংক্ষেপে আমরা লিখি tan)মানে হলো স্পর্শক। তোমরা জানো কোন একটা সরলরেখা যখন কোন বৃত্তকে একটা মাত্র বিন্দুতে ছুঁয়ে যায়, সেই রেখাটিকে বলে স্পর্শক রেখা। tangent শব্দটা এসেছে ল্যাটিন tangere থেকে যার মানে স্পর্শ করা। secant শব্দটার অর্থ হলো ছেদক। একটা সরলরেখা যখন বৃত্তের একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়, অর্থাৎ দুটো বিন্দুকে ছেদ করে বেরিয়ে যায় তাকে বলে ঐ বৃত্তের ছেদক। এই নামটা এসেছে ল্যাটিন secare শব্দটি থেকে যার মানে হলো কেটে ফেলা, ছেদ করা। co-sine বা cos, co-tangent বা cot এবং co-secant বা cosec (একে সংক্ষেপে csc-ও লেখা হয়) – এই নামগুলো আসলে sin ,tan আর  sec থেকেই এসেছে। cosine হলো sine এর সাথী, cotangentহলো tangent এর সাথী এবং cosec হলো sec এর সাথী। সাথী কী জিনিস সেটাতে একটু পরে আসছি। তার আগে নামগুলোর অর্থের দিকে আবার তাকাও। স্পর্শক আর ছেদক নাহয় গণিতের ব্যাপার , এর সাথে tan আর sec কোনভাবে মিলতেও পারে, কিন্তু গর্ত? এর সাথে sin এর সম্পর্ক কী? মজার ব্যাপার হলো- সম্পর্ক আসলেই নেই। এটা একটা ভুল অনুবাদের ফসল!! একটা দারুণ ব্যাপার কী জানো- আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি তার সবকিছুই যে একেবারে সঠিক নিয়ম মেনেই এসেছে তা কিন্তু না। কিছু অদ্ভুত সুন্দর 'ভুল' হয় বলেই আমাদের পৃথিবীটা অনেক বেশি বৈচিত্রময়। যাহোক, এই পর্যায়ে পুরনো ব্যাপারগুলো আরেকবার ঝালিয়ে নেয়া যাক। একটা সমকোণী ত্রিভুজের বাহুগুলো থেকে দুটো দুটো করে নিয়ে মোট ছয়রকম অনুপাত পাওয়া সম্ভব। এই অনুপাতগুলোর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে-
অতিভুজ হলো সবচেয়ে বড় বাহুটা। যেমন ছবিতে AC হলো অতিভুজ।লম্ব আর ভূমি কোনটা হবে এটা বাচ্চাদেরকে অনেক সময়ই ঠিকমতো শেখানো হয় না। অনেকেই মনেই ভুল ধারণা থাকে যে মাটি বরাবর অর্থাৎ অনুভূমিকভাবে যে বাহুটা শুয়ে আছে সেটাই সবসময় ভূমি আর তার উপর লম্বা যে দাঁড়িয়ে আছে, সেই হলো লম্ব। কিন্তু মূল ব্যাপারটা এমন না। আসলে অন্যদুটো বাহুর যেকোন একটা লম্ব আর আরেকটাকে ভূমি ধরা যেতে পারে। কোনটাকে আমরা ভূমি বলব সেটা নির্ভর করবে কোন কোণটিকে নিয়ে আমরা কাজ করছি সেটার উপর। সমকোণ তো সবসময়ই  -এটা নিয়ে এখানে আসলে ভাবার কিছু নেই। বাকি যে সূক্ষকোণ দুটো রইল তাদেরকে নিয়েই আমাদের যত চিন্তা। এখানে  এখানে ∠BAC এবং ∠BCA হলো এমন দুটো কোণ। প্রথমে আমরা ∠BAC এর কথা চিন্তা করি। দেখ এই কোণটি AC এবং AB এই দুটো বাহু মিলে তৈরি। AC তো অতিভুজ। এখন এই AC এর সাথে আর যে বাহুটি রয়েছে সেটিই হবে ‘ভূমি’ অর্থাৎ এখানে AB হলো ভূমি। নিখুঁত করে বললে বলা যায় ভূমি হলো ‘কোণ সংলগ্ন বাহু’,এক্ষেত্রে লম্ব হবে BC (আর কে হবে বলো, আর কেউ কি বাকি আছে??) লম্বকে তাই বলা যায় ‘কোণের বিপরীত বাহু’; তাহলে

        
এখন যদি আমরা অন্য কোণটি অর্থাৎ ∠BCA এর কথা ভাবি, তখন আমরা দেখব ভূমি হয়ে গেছে BC এবং লম্ব হয়ে গেছে  এর বিপরীত বাহু AB । এইবার
 এবারে লক্ষ কর, cos BAC এর মান যা, sin BCA এর মানও তা। আবার sin BAC এর মান যা, cos BCA এর মানও তা। একই সমকোণী ত্রিভুজে থাকা এমন সূক্ষ্মকোণদুটোকে বলে পরস্পরের পূরক কোণ (complementary angle)। এমন একটা কোণের সাইন অন্য কোণের কোসাইনের সমান। সাথী অর্থাৎ co ব্যাপারটা আসলে এখান থেকেই এসেছে। সুতরাং অনুমান করতে পার- এভাবে একটা কোণের সেকান্ট হবে অন্য কোণটির কোসেক্যান্ট এর সমান এবং একটা কোণের ট্যানজেন্ট হবে অন্য কোণটির কোট্যানজেন্ট এর সমান।

আবার ফিরে যাই মূল প্রসঙ্গে- সাইন যদি লম্ব আর অতিভুজের অনুপাত হয়, সেখানে গর্ত কোত্থেকে এল? সেক্যান্ট মানে যদি ছেদকই হবে তার সাথে অতিভুজ আর ভূমির অনুপাতের সম্পর্ক কী?  ট্যানজেন্ট দিয়ে বোঝায়  লম্ব আর ভূমির অনুপাত, তার সাথে স্পর্শকের সম্পর্ক কোথায়?
এই চিন্তাগুলোর জন্ম হয়েছিল গ্রীসে, আর আদরে আদরে বেড়ে উঠেছিল হয়েছিল আমাদের এই উপমহাদেশে। এখন থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আর্যভট (৪৭৬-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ) তার ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ বইটির মধ্যে লিখে গেছেন এই বিষয়গুলোর কথা। তার ধারণা বুঝতে গেলে আমাদেরকে এমন একটা বৃত্তের দিকে তাকাতে হবে, যার ব্যাসার্ধ ১ একক।  
ছবিতে আমরা এমন একটা বৃত্ত এঁকেছি । এখানে OB=OD=বৃত্তের ব্যাসার্ধ= ১ একক। AB হলো BB’ জ্যা-এর অর্ধেক। একে বলা হয় অর্ধ-জ্যা। CC’ এই বৃত্তের একটা ছেদক। এর একটা অংশ হলো OC । এখানে ছেদক বা ছেদকের দৈর্ঘ্য বলতে আমরা OC অংশটুকুকেই বুঝব। আর স্পর্শক বলতে বুঝব CD । এবারে আমরা পুরনো সংজ্ঞাগুলোর দিকে আবার তাকাব। কোণ COD কে আমরা θ নাম দিলাম। তাহলে ΔCOD থেকে আমরা দেখি
যাক বাবা, এতক্ষণ পরে আমরা দেখাতে পেরেছি, সেক্যান্ট আসলেই ছেদকের মান বের করে। এখন tangent –ও আমাদের হতাশ করবে না!
sin  যে অর্ধ-জ্যাকে প্রকাশ করে এটা জেনেও আসলে স্বস্তি হয় না। অর্ধ-জ্যা এর সাথে ‘গর্ত’ ব্যাপারটা কিভাবে মিলল? এখানে আসলে অনুবাদকদের কারসাজি। আর্যভট অর্ধ-জ্যাকে কখনও কখনও ‘জ্যা-অর্ধ’ আবার কখনও কখনও শুধু ‘জ্যা’ লিখতেন। আরব অনুবাদকেরা ভারতবর্ষের গণিতের কাজগুলো যখন সংস্কৃত থেকে আরবিতে অনুবাদ করছিলেন, তারা দেখলেন আরবিতে ‘জ্যা’ এর কোন প্রতিশব্দ নেই। তারা উচ্চারণের সাথে মিল রেখে এটার নাম দিলেন ‘যিবা’(জ্যা → যিঅ্যা → যিবা)  তোমরা হয়তো জানতেও পারো, আরবিতে যখন মানুষ লেখে , অনেক সময়ই তারা আকার-ওকার না দিয়ে অর্থাৎ যের, যবর, পেশ ব্যবহার না করেই লিখে ফেলে। ফলে তারা লিখল ‘য্ ব্’  পরবর্তী প্রজন্মের লেখকেরা যখন এই ‘য্ ব্’ শব্দটা দেখলেন, তারা আর বুঝতে পারলেন না যে এটা হলো ‘যিবা’ তারা দেখলেন য আর ব এর সাথে আকার –ইকার বসিয়ে সুন্দর একটা আরবি শব্দ হয় ‘যাইব্’ যার মানে হলো খাদ বা গর্ত। এরপর ল্যাটিন ভাষার অনুবাদকেরা যখন অনুবাদ করলেন , তারা ল্যাটিন ভাষায় গর্তের প্রতিশব্দ হিসাবে এর নাম রাখলেন sinus , তার থেকেই পরবর্তীতে এল sine. এভাবেই আর্যভটের সেই অর্ধ-জ্যা অর্ধদুনিয়া ঘুরে হয়ে গেল গর্ত! কী অদ্ভুত!


এসব জেনে লাভ কী??এই প্রশ্নটার মুখোমুখি আমাকে প্রায়ই হতে হয়। এই যে এসব নাম-টাম কোত্থকে এল, কে নাম দিল-এইসব জেনে লাভটা কী? তার চেয়ে শুধু এগুলো কিভাবে কাজ করে এইটা জানলেই কি হয় না? নাহ! চোখের দেখা দেখেই লাভ-ক্ষতির হিসেবটা আসলে করে ফেলা যায় না। যা কিছু শুধুই যুক্তির, শুধুই প্রয়োজনের, তা দিয়ে ভালবাসা ব্যাপারটাকে বোঝা যায় না! যে মানুষটা শুধুই তার প্রয়োজনের সময় তোমাকে স্মরণ করে, সে তোমাকে ভালবাসে কিনা তুমি বুঝবে না! ধরো তোমার পাশের বন্ধুটার সাথে তোমার এমন সম্পর্ক- তুই আমাকে এই নোটটা দিবি, আমি তোকে ঐটা দেব। এমন প্রয়োজনের সম্পর্ক থেকে তোমাদের বন্ধুত্ব কতখানি তীব্র, এটা বোঝা যাবে না। কিন্তু ধরো, একদিন বন্ধুটা চুপচাপ বসে আছে, তুমি পাশে গিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলে- 'তোর কি মন খারাপ'? এই 'অপ্রয়োজনীয়' কথাটুকুর মধ্যে অনেক বেশি গভীরতা আছে, ভালবাসা আছে! এবং তুমি প্রায়ই দেখবে একটা তুচ্ছ অপ্রয়োজনীয় কথা কিংবা কাজ থেকে তৈরি হওয়া বন্ধুত্বটুকু, ভালবাসাটুকু সারাজীবনে তোমাকে যা কিছু দেবে, হাজার হাজার প্রয়োজনীয় কথাও সেটা পারবে না! জ্ঞানের ব্যাপারটাও ঠিক তাই। গণিত এর একটা ছোট্ট 'অপ্রয়োজনীয়' গল্প তোমার মধ্যে যদি ভালবাসার একটা একটা ছোট্ট বীজ বুনে দেয়- সে যে একদিন মহীরূহ হয়ে উঠবে না, কে বলতে পারে! আমরা মানুষ- যুক্তি দিয়ে যা বুঝি তাকে যখন আবেগ দিয়ে অনুভব করি , সেই জ্ঞানটা আমাদেরকে অনেক বেশি মানসিক শক্তি যোগায়, এগিয়ে নিয়ে যায় আরও অনেক অনেক দূর!

লিখেছেন সবার প্রিয় চমক হাসান 






0 comments: