কিছু ব্যাতিক্রমী জেনেটিক ডিসঅর্ডার - ২য় পর্ব

0
কিছু ব্যাতিক্রমী জেনেটিক ডিসঅর্ডার - ১ম পর্ব


রাজশাহী থেকে কুষ্টিয়া যাবার পথে ঈশ্বরদী স্টেশনে প্রায়ই একটি ছোট ছেলেকে দেখা যায়। দূর থেকে দেখে ছোট ছেলেটাকে খুব হাসি খুশি আর প্রাণবন্ত বলেই মনে হয়। তৃতীয় বার যখন ছেলেটাকে দেখলাম তখন বুঝলাম ছেলেটির হাতের আঙ্গুল মাত্র দুইটি করে এবং ছেলেটির মানসিক বিকাশ কিছুটা বাধাগ্রস্থ বলেই মনে হল। আজ কোন রোগ নিয়ে লিখবো ভাবতে গিয়ে হঠাৎ ওর কথা মনে হল আর তাই ভাবছি আজ ওর রোগটি নিয়েই লিখবো। আজ লেখা হচ্ছে এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব।

রোগের নামঃ Ectrodactyly


Ectrodactyly শব্দটি মূলত একটি গ্রীক শব্দ, যার মানে হল আঙ্গুলের বিকৃতি (Abortion of Finger), কোন কোন ক্ষেত্রে আবার বলছে দৈত্যাকৃতির আঙ্গুল (Monstorus Finger)। নামের অর্থ যায় হোক না কেন ফলাফল ইতিমধ্যে আশা করি ধারণা করা হয়ে গেছে, হ্যাঁ ঠিক তাই। এই রোগের ফলে হাত বা পায়ের
মাঝের এক বা একাধিক আঙ্গুল অনুপস্থিত থাকে, যার ফলে হাত চিমটার ন্যায় আকৃতি নেয়। Ectrodactyly অনেক ভাবে অনেক রকম হতে পারে। কখনো দেখা যায় একটি বা দুইটি আঙ্গুল অনুপস্থিত, আঙ্গুল না থাকার দরুন ফাঁকা জায়গা বা খাঁজ সৃষ্টি হতেও পারে নাও পারে।(এই মুহূর্তে একটি অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে নেওয়া উচিত, হাতে বা পায়ে অতিরিক্ত আঙ্গুলের উপস্থিতিকে Syndactyly বলে।) Ectrodactyly রোগের আরও কতগুলো নাম আছে lobster-claw syndrome, split-hand or split-foot malformation। এই রোগের এই সমস্যার সাথে আরও কিছু আনুসাঙ্গিক সমস্যা জড়িত থাকতে পারে, তবে সব সময় থাকবে এমন কোন কথা নেই। যেমন কম উচ্চতা, ঠোঁট বা তালু কাটা রোগ, কানে কম শোনার সমস্যা ইত্যাদি। কোন কোন ক্ষেত্রে এই রোগ আরও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এ রকম একটি অবস্থার নাম "EEC" দ্বারা যার মানে হল E=Ectrodactyly, E=Ectodermal Dysplasia, C= Facial Cleft Syndrome।


Ectodermal Dysplasia মানে হল ভ্রূণের তিনটি কোষ স্তরের মধ্য থেকে সবার বাইরের, এক্টোডার্ম, স্তর থেকে উৎপন্ন যে কোন দুই বা তিনটি জিনিসের অনুপস্থিতি। যেমন হতে পারে চুল, নখ, দাঁত, ঘাম গ্রন্থি ইত্যাদির অনুপস্থিতি।

অপর দিকে Facial Cleft Syndrome হল তালু কাটা রোগ বা ঠোটে এক বা একাধিক জন্মগত কাটা দাগ ( চিত্র দ্রষ্টব্য) ।

এই রোগ আক্রান্ত মানুষের মধ্যে নারী ও পুরুষের অনুপাত প্রায় ১:৫, এই রোগের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এই রোগে আক্রান্তদের সব সময়ই কনিষ্ঠা আঙ্গুলে কোন সমস্যা হয় না।

রোগের কারনঃ

এই রোগের কারণ হিসাবে জীনগত অনেক ধরণের পরিবর্তনকে দায়ী করা যেতে পারে। তবে মূলত ৭ নাম্বার ক্রোমোসোমের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জেনেটিক পরিবর্তন যেমন ক্রোমোসোমের ডিএনএ এর কিছু অংশ হারিয়ে যাওয়া(Deletion), অন্য ক্রোমোসোমের হতে অংশ সংযুক্ত হয়ে ঘটা পরিবর্তন (Translocation), কিংবা ক্রোমোসোমের একটি নির্দিষ্ট অংশের বিন্যাসের পরিবর্তন (Inversion) ইত্যাদিকে এই রোগের কারণ হিসাবে ধরা হয়।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল অধিকাংশ মানুষ (প্রায় ৭০%) যে কারণে এই রোগে আক্রান্ত হন তা হল তার পূর্বপুরুষের কেউ একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, মানে এই জেনেটিক পরিবর্তন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রভাব রাখে। এই ঘটনাকে Autosomal Dominant বলে।

রোগটি কিভাবে হয়ঃ
পূর্বেই বলা হয়েছে এই রোগের মূল লক্ষনের সাথে আরও অনেক গুলো জটিল সমস্যা যেমন বামনত্ত, কানে শুনতে সমস্যা ইত্যাদি জড়িত। কিন্তু আমি এখানে মূলত আঙ্গুল তৈরির না হবার বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা এই রোগে জীনগত পরিবর্তনের ফলে apical ectoderm of the limb bud এর গঠনে একটি স্থান ফাঁকা রয়ে যায় যার ফলশ্রুতিতে ঐ অংশে আঙ্গুল তৈরি হয় না। তবে ঠিক কি প্রক্রিয়াতে এই ফাঁকা স্থানের সৃষ্টি হয় তা নিয়ে এখনও মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ আবার বলতে চাচ্ছেন যে Polydactyly, syndactyly and cleft hand তিনটি রোগের রোগতত্ত্ব প্রায় একই রকমভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে।

জীনের অবস্থানঃ
এই রোগ বা এই রোগের ন্যায় লক্ষন অনেক জীনের প্রভাবেই হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি যে দুটো জীনের পরিবর্তনের ফলে হয়ে থাকে আমরা এখানে শুধু সে দুটোই উল্লেখ করছি।
Cytogenetic Location: 7q21-q22
এই স্থানে মিউটেশনের ফলাফল হিসাবে SHSF বা Split Foot/Split Hand Syndrome দেখা দেয়।

Cytogenetic Location: 3q27 (যার অপর নাম p63 gene)
এই স্থানে মিউটেশনের ফলাফল হিসাবে শুধু SHSF কিংবা EEC Syndrome হতে পারে।


Cytogenetic Location সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।

প্রকারভেদঃ
Manske and Halikis Classification অনুসারে মূলত পাঁচ ধরনের। নিচে চিত্রের সাহায্যে প্রকারভেদ দেখানো হলঃ

Type I





Type II

Type III

Type IV

Type V


Type IIB
















এই ৭ নাম্বার ক্রোমোসোম সংক্রান্ত আরও কিছু রোগঃ

Russell-Silver syndrome, 
এরা জন্মের সময় অপেক্ষাকৃত কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে এবং এদের জন্মের পর সময় অনুযায়ী ওজন বৃদ্ধি পায় না। তবে মাথার ওজন স্বাভাবিক থাকে বলে এদের মাথার আকার স্বাভাবিকের চেয়ে বড় বলে মনে হয়
Saethre-Chotzen syndrome, 
এই রোগের ফলে মূলত মাথার অস্থিগুলো নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই একটি আরেকটি সাথে সংযুক্ত হয়ে যায় ফলে মস্তিস্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয়।
Williams syndromeএই রোগে আক্রান্তদের মানসিক বিকাশ অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্থ হয়। এরা ছবি আঁকা কিংবা পাজল মেলাবার ক্ষেত্রে দুর্বল হয় তবে যে কোন কিছু মুখস্থ করার ক্ষেত্রে এরা ওস্তাদ হয়।
আজকের পর্ব এখানেই শেষ, আশা করছি তৃতীয় পর্ব খুব দ্রুতই লিখে শেষ করতে পারবো।

0 comments: