কিছু ব্যাতিক্রমী জেনেটিক ডিসঅর্ডার - ১ম পর্ব

0
আমাদের চারপাশের প্রতিটি মানুষ একে অপরের চেয়ে  চেহারায় আলাদা, কিন্তু কেন? এর  উত্তরে খুব সহজেই বলে দেওয়া যায় জেনেটিক কারণে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে প্রতিটি মানুষের চেহারার গঠনই নাকি ভিন্ন এমনকি Identical Twin এর ক্ষেত্রেও। কিন্তু আজ তা নিয়ে বলব না। আজ বলব সেই সব মানুষের কথা যারা এই পৃথিবীতে স্বাভাবিক মানুষের মত সুস্থ ভাবে জন্ম নেন নি। আমরা আজ কিছু সচরাচর দেখা যায় না এমন জেনেটিক মিউটেশন বা পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করবো। এই লেখাটি বেশ কয়েকটি পর্বে শেষ হবে। আজ এর প্রথম পর্ব। যে কোন রূপ তথ্যগত অসঙ্গতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা রাখি।


রোগের নামঃ Progeria

এই রোগটি ঠিক যেমন দুর্লভ তেমনি মারাত্মক। প্রতি ৮০ লাখ বাচ্চার মধ্যে একজনের এই রোগ দেখা যায়। এই রোগের আরও ভালো নাম হল Hutchinson-Gilford Progeria। এই রোগে যারা আক্রান্ত হন তারা দ্রুত বুড়িয়ে যেতে থাকে। যে সকল বাচ্চা এই রোগে আক্রান্ত হয় তারা সাধারণত বার্ধক্যজনিত রোগেই
মারা যায়। সাধারণত এই রোগের প্রকোপ মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায় ১৩ বছরের আসে পাশে, এবং বাচ্চাটি মারা যায়, খুব কম বাচ্চাই ২০ বছর বেঁচে থাকতে পারে। মৃত্যুর কারণ হিসাবে মূলত দেখা যায় হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক।

রোগের কারনঃ
LMNA বা lamin A/C জীনের পরিবর্তন।

জীনটির প্রতীক হল LMNA এবং নাম হল lamin A/C। জীনের এই নামকরণ ও প্রতীক প্রদান কাজটি করে হল HUGO Gene Nomenclature Committee।

LMNA জীনের সাধারন কাজঃ
এই জীনের মূল কাজ হল ল্যামিন নামে একধরনের প্রোটিন তৈরি করা। এই জীনের প্রভাবে শরীরের প্রায় সব কোষ হতে মূলত দুই ধরণের ল্যামিন তৈরি হয়; ল্যামিন A ও ল্যামিন C, যারা মূলত কোষের  intermediate filament proteins হিসাবে কাজ করে। গঠনগত দিক থেকে ল্যামিন A ও ল্যামিন C প্রায় একই রকম হলেও ল্যামিন A ল্যামিন C এর তুলনায় অ্যামিনো অ্যাসিডের চেইনের দিক থেকে একটু বড়। আরও একটি বড় পার্থক্য হল নিউক্লিয়ার ল্যামিনাতে যুক্ত হবার আগে ল্যামিন A কে কিছু জটিল পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রিল্যামিন A হতে  ল্যামিন A তে পরিবর্তিত হতে হয়,  ল্যামিন C এর এই ধরণের কোন পরিবর্তন হয় না। এই প্রোটিন গুলো কোষের স্থায়িত্ব ও শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া নিউক্লিয়াসের আবরনের এরা একটি সাহায্যকারী গঠন উপাদান। নিউক্লিয়ার ল্যামিনাতে এদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ধারণা করা হয় এরা নিউক্লিয়ার মেমব্রেনে থাকে বলে নিউক্লিয়াসের মধ্যে বিভিন্ন পদার্থ আদান প্রদানে এদের ভূমিকা রয়েছে।


LMNA জীনের অবস্থানঃ

Cytogenetic Location: 1q22
Molecular Location on chromosome 1: base pairs 156,052,368 to 156,109,879

যেহেতু এটি প্রথম পর্ব তাই  Cytogenetic Location সম্পর্কে একটু ব্যাখ্যা দেই। এই ধরণের লোকেশনের মূলত তিনটি অংশ আছে। প্রথমেই থাকে একটি সংখ্যা অথবা X বা Y অক্ষর। ১ থেকে ২২ দ্বারা অটোসোম ক্রোমোসোম সংখ্যাকে এবং Xও Y দ্বারা সেক্স ক্রোমোসোমকে  বোঝানো হয়। এর পর থাকে একটি অক্ষর। সাধারণত একটি ক্রোমোসোমকে সেন্ট্রোমিয়ারের উপর নির্ভর করে দুইটি বাহুতে ভাগ করা হয়, ছোট বাহুকে p এবং বড় বাহুকে q দ্বারা প্রকাশ করা হয়।  5q মানে হল ৫ নাম্বার  ক্রোমোসোমের বড় বাহু। এর পর থাকে আরও একটি সংখ্যা একে বলা হয় ব্যান্ড নাম্বার। ক্রোমোসোমকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় রঞ্জিত করলে এর বাহুতে কিছু হালকা এবং গাঢ় ব্যান্ড দেখা যায়। সাধারণত এক্ষেত্রে দুইটি সংখ্যা দ্বারা একটি অঞ্চল ও ব্যান্ডকে নির্দেশ করা হয়। সংখ্যা যত বড় হয়, সেন্ট্রোমিয়ার থেকে ব্যান্ডের অবস্থান তত দূরে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে আবার দশমিক দিয়ে তার পরে একাধিক সংখ্যা থাকতে পারে যা কিছু সাব- ব্যান্ডকে নির্দেশ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরও দুইটি শব্দ দেখা যায় cen এবং ter যা দ্বারা যথাক্রমে সেন্ট্রোমিয়ারের একেবারে কাছে ও বাহুর একেবারে শেষের অবস্থান নির্দেশ করা হয় । tel এবং ter দ্বারা একই অঞ্চল বোঝানো হয়। ter দ্বারা terminus ও tel দ্বারা telomere বোঝানো হয়।

সুতরাং আমরা বুঝতেই পারছি আমাদের কাঙ্খিত LMNA জীনের অবস্থান প্রথম ক্রোমোসোমের q বাহুর 2 নাম্বার রিজিওন বা অঞ্চলের 2 নাম্বার ব্যান্ডে।

জীনের Molecular Location দ্বারা মূলত জীনের অবস্থান সবচেয়ে ভালো বোঝা যায়। ভাগ্য ভালো হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টটি সফল হয়েছিল। যদিও বিজ্ঞানীদের মধ্যেই অনেক জীনের Molecular Location নিয়ে কিছুটা ভিন্ন মত দেখা যায়।

এই রোগের জেনেটিক পরিবর্তনঃ

এই রোগে সাধারণত জীনের একটি নিউক্লিওটাইডের পরিবর্তন ঘটে। ১৮২৪ তম নিউক্লিওটাইডে সাইটোসিনের পরিবর্তে থাইমিন এসে যুক্ত হয়। এই পরিবর্তনের ফলে ল্যামিন A শুধুমাত্র পরিবর্তিত হয়, ল্যামিন C অপরিবর্তিত থাকে। এই পরিবর্তিত ল্যামিন A কে প্রজেরিন বলে যার এক প্রান্তে প্রায় ৫০ টি অ্যামিনো অ্যাসিডের ঘাটতি থাকে। যার ফলে নিউক্লিয়াসে ল্যামিন A এর যে জটিল পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল টা হয় না, ধারণা করা হয় এরই ফলশ্রুতিতে নিউক্লিয়াসে গাঠনিক পরিবর্তন আসে এবং কোষের বার্ধক্য জনিত সমস্যা দেখা দেয়।


বামের ছবিটি www.globalgenes.org ও ডানের ছবিটি www.sunshinefoundation,org থেকে নেওয়া

এই জীন সংক্রান্ত আরও কিছু রোগঃ

Charcot-Marie-Tooth disease:
এতে মূলত নার্ভের সমস্যা হয় যার ফলে পায়ের পাতা, পা এবং হাতের মাংসপেশির অনুভূতি নষ্ট হয় এবং কোষ মারা যায় (Atrophy)। এক্ষেত্রে  ল্যামিন A ও ল্যামিন C উভয় প্রোটিনের একটি অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিবর্তন ঘটে। ২৯৮ তম অবস্থানে আরজিনিনের পরিবর্তে সিস্টিন বসে।

Emery-Dreifuss muscular dystrophy:
এই রোগে মিউটেশনের পরিমান ১০০ এর চেয়ে বেশি। এতে মূলত কার্ডিয়াক ও স্কেলেটাল মাংসপেশির সমস্যা হয়।

limb-girdle muscular dystrophy, mandibuloacral dysplasia ইত্যাদি সহ আরও কিছু রোগের জন্যও এই LMNA জীন দায়ী।

আজকের পর্ব এখানেই শেষ, আশা করছি দ্বিতীয় পর্ব খুব দ্রুতই লিখে শেষ করতে পারবো।

0 comments: