এক্স ক্রোমোসোম ইনঅ্যাক্টিভেশনঃ

0
আমরা জানি মানুষের মাঝে লিঙ্গ ভিন্নতার মূলে আছে নারীদের ক্ষেত্রে দুইটি এক্স ক্রোমোসোম ও পুরুষের ক্ষেত্রে একটি এক্স ও একটি ওয়াই ক্রোমোসোম। পুরুষেরা কী করে একটি এক্স ক্রোমোসোম নিয়ে বাঁচতে পারে যেখানে সকল ক্রোমোসোমাল মনোসোমি প্রায় লিথাল। মূলত নারীদের শরীরে একটি এক্স ক্রোমোসোমের সকল কাজ প্রায় বন্ধ থাকে, যা এক্স ক্রোমোসোম ইনঅ্যাক্টিভেশন নামে পরিচিত।এক্স ক্রোমোসোম ইনঅ্যাক্টিভেশন প্রক্রিয়াতে নিউক্লিয়াসে এক্স ক্রোমোসোমের সংখ্যার উপর নির্ভর করে এক বা একাধিক এক্স ক্রোমোসোম ইনঅ্যাক্টিভেটেড হয় এবং ঘন হেটারোক্রোমাটিন স্ট্রাকচার তৈরি করে। এই প্রক্রিয়া আজ থেকে প্রায় ৫৩ বছর আগে ম্যারি লিওন আবিস্কার করেন।

আপাতত দৃষ্টিতে এক্স ক্রোমোসোম ইনঅ্যাক্টিভেশন প্রক্রিয়াকে খুব সাধারণ প্রক্রিয়া বলে মনে হলেও তা খুবই জটিল। এক্স অ্যাক্টিভেশন প্রক্রিয়াতে মূলত যা হয় তা হল একটি এক্স ক্রোমোসোমে এপিজেনেটিক পরিবর্তন এনে  সম্পূর্ণরূপে একে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়। সর্বপ্রথম এ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের কয়েকটি প্রশ্ন খুব ভাবিয়ে তোলে কিভাবে কোষ নিউক্লিয়াসে এক্স ক্রোমোসোম সংখ্যা নির্ণয় করে? কী করে একটি বাদে বাকিগুলোতে পরিবর্তন হয়?কী মলিকুলার মেকানিসমে আস্ত একটা এক্স ক্রোমোসোমে এই মেটামরফোসিস সংঘটিত হয়?কখন এই ঘটনা শুরু হয়? ডিম্বাণু সৃষ্টির আগে কী করে আবার এই ঘটনা রিসেট হয়?

আমি চেষ্টা করবো এ প্রশ্ন গুলো নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করতে।প্রথমে শুধু আলোচনা করবো আবিষ্কারের অংশটুকু নিয়ে।

১৯৪৯ সালে মেয়ে ক্যালিকো বিড়ালের মটর নিউরন পরীক্ষা করতে গিয়ে বার এবং তার পিএইচডি স্টুডেন্ট বারটাম নিউক্লিওলাসের কাছে ঘন ও কালো একটি গঠন দেখতে পান। তখনও তারা জানতেন না এটা আসলে এক্স ক্রোমোসোম।তারা এর নাম দেন বার বডি। পরবর্তীতে বার বডি যে আদতে এক্স ক্রোমোসোম তা আবিষ্কার করেন সুসোমো অহনো। ১৯৬১ সালে ম্যারি লিওন বলেন  হেটারোক্রোমিক এক্স ক্রোমোসোম বা যে এক্স ক্রোমোসোম ইনঅ্যাক্টিভেটেড হয় তা ঐ নিউক্লিয়াসেরই অংশ এবং মায়ের কাছ থেকে পাওয়া বা পিতার কাছ থেকে পাওয়া এক্স ক্রোমোসোমে ঘটে থাকে।  এ প্রক্রিয়াতে সম্পূর্ণ এক্স ক্রমোসোমকে ঘিরে একটি গ্লোবাল সাইলেন্সিং প্রক্রিয়া ঘটে থাকে। পরবর্তীতেglucose-6-phosphate dehydrogenase deficiency(heterozygous for G6pdx gene) তে আক্রান্ত একই নারীর দেহে দু ধরনের লোহিত কণিকা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিউটলার ও তার সহকর্মীরা এই তত্ত্বকে আরো শক্তিশালী করে।

যাদের জিনোমে একের অধিক এক্স ক্রোমোসোম আছে তাদের দেহে ইনঅ্যাক্টিভেটেড এক্স ক্রোমোসোমের সংখ্যা নিয়ে গবেষণা করতে মেরি লিওনের তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করে। স্বাভাবিকভাবেই তারা দেখতে পায় নারীদের দুইটির মধ্যে একটি করে এক্স ক্রোমোসোম ইনঅ্যাক্টিভ ওপর দিকে ছেলেদের একটি করে এক্স ক্রোমোসোম যা অ্যাক্টিভ। এটা সাধারণ নিয়ম। কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন ট্রিসোমি এক্স(44+xxx) কিংবা ক্লিনফেল্টার সিনড্রোমের(44+XXY) ক্ষেত্রে কী ঘটবে? ট্রিসোমি এক্স এর ক্ষেত্রে ইনঅ্যাক্টিভ এক্স ক্রোমোসোমের সংখ্যা ২টি এবং ক্লিনফেল্টার সিনড্রোমের ক্ষেত্রে ইনঅ্যাক্টিভ এক্স ক্রোমোসোমের সংখ্যা ১টি। মজার তথ্য হচ্ছে চারটি এক্স ক্রোমোসোম যুক্ত টেট্রাপ্লোয়েড মানবকোষ নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন সেখানে ইনঅ্যাক্টিভ এক্স ক্রোমোসোমের সংখ্যা মাত্র দুইটি। ফলে যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় তা হল অ্যাক্টিভ এক্স ক্রোমোসোমের সংখ্যা হবে প্রতি ডিপ্ললেড সেটে একটি করে এবং বার বডির সাথে ব্যক্তির লিঙ্গ কী হবে তার কোন সম্পর্ক নেই। তবে ইতিপূর্বে ১৯৬১ সালের অলিম্পিকে বার বডির উপস্থিতিকে প্রতিযোগী ছেলে না মেয়ে তা নির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

এক্স ক্রোমোসোম ইনঅ্যাক্টিভেশন  বিষয়ে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য আসে কোন এক্স ক্রোমোসোম অ্যাক্টিভ আর কোনটি ইনঅ্যাক্টিভ হবে তা নির্ধারণের মেকানিসম নিয়ে। প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হয়েছিল এটি পুরোপুরি র‍্যান্ডম। বিড়ালে মোজাইকের মত দেখতে কালার কোট নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই তথ্য বের হয়ে আসে। পরবর্তীতে গাছের একই পাতায় নানা রঙ নিয়ে গবেষণা থেকেও একই তথ্য পাওয়া যায়। প্রাণীদের যেমন ইঁদুর বা বিড়ালের ক্ষেত্রে দেখা যায় শুধু মাত্র মেয়েগুলোই ছোপ ছোপ দাগ যুক্ত কোট কালার পেয়ে থাকে। আমরা ধরে নেয় একটি প্রাণীতে প্রকট বৈশিষ্ট্যের জিন G ও প্রছন্ন জিন g রয়েছে। ধরি প্রকট জিন G এর জন্য বিড়ালের রঙ বাদামী হয় এবং প্রচ্ছন্ন জিন g এর জন্য কালো হয়।সুতরাং কোন প্রাণীর জিনোটাইপ Gg হলে অবশ্যই তার রঙ বাদামী হওয়া উচিত। কিন্তু এই জিন যদি এক্স ক্রোমোসোমে অবস্থান করে তবে কিন্তু ভবিষ্যৎবাণী করাটা এত সোজা হবে না। কারণ যদি G  অ্যাক্টিভ এক্স ক্রোমোসোমে থাকে তবে রঙ হবে বাদামী কিন্তু g  অ্যাক্টিভ এক্স ক্রোমোসোমে থাকে তবে রঙ হবে কালো। এখন যা দেখা যায় তা হল একই প্রাণীর কোন কোষে G যুক্ত আবার কোন কোষে g যুক্ত এক্স ক্রোমোসোম অ্যাক্টিভ থাকে। কিন্তু এই দুই ধরনের কোষের অনুপাতের ক্ষেত্রে একটি অনেক বেশি হবে আরেকটি কম। কোন কোষে কোনটি  ইনঅ্যাক্টিভ হবে তা মূলত গ্যাস্ট্রুলেশন ধাপের  তা কাছাকাছি সময়ে নির্ধারণ হয় এবং তা মাইটোটিক্যালি বর্তমান থাকে মেয়ে প্রাণীর সম্পূর্ণ জীবনকাল ধরে

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল এক্স ইনঅ্যাক্টিভেশনের নির্বাচন প্রক্রিয়া পুরোপুরি র‍্যান্ডম বা দৈবচয়নে হয়ে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে আরও এক ধরনের এক্স ক্রোমোসোম ইনঅ্যাক্টিভেশনের প্রক্রিয়া পাওয়া যায় যার নাম ইমপ্রিন্টেড এক্স ইনঅ্যাক্টিভেশন। ইমপ্রিন্টেড এক্স ইনঅ্যাক্টিভেশন প্রক্রিয়াতে পিতার দেহ থেকে আসা ক্রোমোসোমটি কোষে নিষ্ক্রিয় হয়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই মাতা ও পিতার কাছ থেকে আসা এক্স ক্রোমোসোমে নিশ্চয়ই কিছু ভিন্নতা থাকে যার ফলে পিতা থেকে আসা এক্স ক্রোমোসোমকে আলাদা করে চেনা যায়। আসলে পিতা থেকে আসা এক্স ক্রোমোসোমে এপিজেনেটিক প্রক্রিয়াতে দেওয়া নির্দিষ্ট চিহ্ন থাকে এবং সেই চিহ্ন দেখে মলিকুলার মেকানিসম ঐ এক্স ক্রোমোসোমটিকে ইনঅ্যাক্টিভ করে দেয়। এ প্রক্রিয়াটি জরায়ুতে ভ্রূণ ইমপ্লান্টেশনের পূর্বেই সংঘটিত হয়ে থাকে। ইঁদুরের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াতে  সমস্ত প্লাসেন্টাতে এক্স ইনঅ্যাক্টিভেশন সংঘটিত হয়।


এক্স ক্রোমোসোম ইনঅ্যাক্টিভেশনের ক্ষেত্রে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলঃ

গণনা (Countng): এক্স ক্রোমোসোম ইনঅ্যাক্টিভেশনের প্রথম দুইটি ধাপের সাথে মূলত জড়িয়ে আছে Xist নামক Long non encoding RNAXist এর পূর্ণরূপ হল X Inactivation Specific Transcriptএটি Long non encoding RNA গুলোর মধ্যে এটি সবার আগে ১৯৯১ সালে আবিষ্কার হয়। Long non encoding RNA এর দুইটি বৈশিষ্ট্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।প্রথমত এরা ট্রান্সক্রিপসন প্রক্রিয়ায় যেখান থেকে উৎপন্ন হয়ম উৎপন্ন হবার পর তারা সেখানেই অবস্থান করে এবং দ্বিতীয়ত এরা কোনো প্রোটিন তৈরি করে না। Xist এক্স ইনঅ্যাক্টিভেশনের জন্য মৌলিক ভূমিকা পালন করে। এটি প্রায় ১৭০০০ বেস নিয়ে গঠিত। Xist RNA এক্স ক্রোমোসোম থেকে তৈরি হয়। ধরি একটি কোষে দুইটি এক্স ক্রোমোসোম আছে। দুইটিতেই Xist RNA তৈরির জিন রয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র একটি জিন অ্যাক্টিভ হবে অর্থাৎ Xist RNA তৈরি করবে। মনে রাখার মত বিষয় হচ্ছে এই Xist DNA দ্বারা মলিকুলার মেকানিসম বুঝতে পারে কোষে কতগুলো এক্স ক্রোমোসোম আছে এবং যে ক্রমোসোমের Xist DNA থেকে RNA তৈরি হবে ক্রোমোসোমটি মূলত ইনঅ্যাক্টিভেট হবে। মানে বিষয়টা এমন যে আগে মাথা চারা দেবে তার দেহ কাটা পড়বে। কোন ক্রোমোসোমের Xist DNA আগে Xist RNA তৈরি করবে তা Xist DNA এর আশেপাশে অবস্থিত বিভিন্ন কন্ট্রোল এলিমেন্ট নিয়ন্ত্রন করে।

নির্বাচন(Choice): কোন এক্স ক্রোমোসোমটি ইনঅ্যাক্টিভ হবে তা ঠিক কী প্রক্রিয়াতে নির্দিষ্ট হয় তা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। কোন ক্রোমোসোম থেকে কেন আগে Xist RNA তৈরি হয় তা এখানে মূল রহস্য। এম্রায়োনিক স্টেম সেল অবস্থায় পিতার কাছ থেকে ও মাতার কাছে থেকে পাওয়া উভয় এক্স ক্রোমোসোম সক্রিয় থাকে। তার কিছু পরে দুইটি এক্স ক্রোমোসোমের মধ্যে কিছু অংশ একত্রে পাশাপাশি এসে যুক্ত হয় এবং তাদের মধ্যে কিছু ফ্যাক্টর আদানপ্রদান হয় এই একত্র হওয়াকে transient co-localization of X chromosomes বলে। ধারণা করা হচ্ছে এই ফ্যাক্টর আদান প্রদানের মধ্যদিয়েই ঠিক করা হয় কোন ক্রোমোসোমটি নিষ্ক্রিয় হবে।সাধারণত XIC (X Inactivation Center) নামক স্থানে দুইটি এক্স ক্রোমোসোম যুক্ত হয়। ওপর দিকে ইনপ্রিন্টেড এক্স ইনঅ্যাক্টিভেশন প্রক্রিয়া তো আছেই।

সূচনা(Initiation):এ ধাপে মূলত কিছু ফ্যাক্টরের প্রভাবে Xist RNA সম্পূর্ণ এক্স ক্রোমোসোমকে ঢেকে ফেলে।

ব্যাপ্তি(spreading): এধাপে এক্স ক্রোমোসোমটিকে Silent Nuclear compartment Region এ নিয়ে যাওয়া হয়এ অংশে RNA Polymerase II নামক RNA Polymerase এনজাইম যা DNA কে ট্রান্সক্রিপশন করে তা অনুপস্থিত থাকে। এছাড়াও আরও কিছু ফ্যাক্টর যেমন PAR1 and PAR2 (Pseudoautosomal Region 1 and 2) এবং SATB1 এবং SATB2(Special AT-rich sequence-binding protein 1 and 2) এর ভূমিকা রয়েছে

স্থায়িত্ব লাভনিয়ত্রন (Establishment and Maintainance):ইতিমধ্যে আমরা জানি প্লাসেন্টা বা অমরাতে ইমপ্রিন্টেড এক্স ইনঅ্যাক্টিভেশন হয় এবং বাকি কোষে র‍্যান্ডম এক্স ইনঅ্যাক্টিভেশন হয়ে থাকে। এই ইনঅ্যাক্টিভেশন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হয়ে যায়। এক্স ইনঅ্যাক্টিভেশনের সবচেয়ে বড় পর্যায় হল এই নিষ্ক্রিয় অবস্থা বজায় রাখা যার পর্যায় কাল প্রাণীর সমস্ত জীবন। এই বিশাল পর্যায়কাল যাবত কিন্তু আগের ফ্যাক্টর গুলো কাজ করে না, তাদের কাজ  এক্স ইনঅ্যাক্টিভেশনের প্রতিষ্ঠা পর্যন্তই।

এক্স ইনঅ্যাক্টিভেশন নিয়ত্রনের বা বজায় জন্য দুইটি ফ্যাক্টরের ভূমিকা সর্বাধিক Dnmt1(DNA Methyltransferase 1) and Smchd1(Structural maintenance of chromosomes flexible hinge domain 1).
জেনে রাখার মত বিষয় হচ্ছে Smchd1 এর উপস্থিতি ছাড়া কোন পুরুষের জন্ম সম্ভব নয়। Smchd1 এর অনুপস্থিতে পুরুষ ভ্রূণ গভাবস্থাতেই মারা যায়।
  

0 comments: