আঞ্জেলম্যান সিনড্রোম ও এই রোগ চিকিৎসায় নতুন বায়োমার্কার

0
আঞ্জেলম্যান সিনড্রোম একটি বিরল জীনগত স্নায়ুঘটিত রোগ যা প্রথম আবিষ্কার করেন অ্যাঞ্জেলম্যান নামে একজন ইংরেজ শিশু বিশেষজ্ঞ। প্রায় প্রতি ১৫০০০ শিশুর মধ্যে ১জন শিশুতে এই রোগ দেখা যায় এবং সাধারণত ৬ থেকে ১২ মাস বয়সের মধ্যেই এই রোগের লক্ষণ স্পষ্ট বোঝা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এ রোগ সেরিব্রাল পালসি বা অটিজম বলে ভুল হয়ে থাকে। রোগ লক্ষণের মধ্যে রয়েছে মানসিক উন্নয়ন জনিত বিলম্ব, কথা বলতে না পারা, খিঁচুনি, হাঁটা এবং ভারসাম্য রক্ষাজনিত সমস্যা।এছাড়াও এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা হাসিখুশি মনোভাবের হয় এবং প্রায়ই হাসে। এই রোগের মূল কারণ হল মায়ের দেহ থেকে আসা ১৫ নাম্বার ক্রোমোজোমের বড় বাহুর ১২ নাম্বার ব্যান্ডে (15q12) অবস্থিত UBE3A(ubiquitin protein ligase E3A) জিনের বিলুপ্তিকরণ কিংবা নিস্ক্রিয়করণ। এই রোগে আক্রান্ত প্রায় ৬৮% মানুষের মধ্যেই উল্লেখকৃত জিনের বিলুপ্তিকরন দেখা যায় তবে এছাড়াও ইউনিপ্যারেন্টাল ডাইসোমি(৩%) ( বাবা কিংবা মা একজনের কাছে থেকে এক জোড়া ক্রোমোসোম চলে আসা), জিনের মিউটেশন(১৩%) কিংবা ইম্প্রিন্টিং সেন্টার( এটি ডিএনএ এর ছোট্ট একটি অঞ্চল যা নিয়ন্ত্রণ করে জিনটি সক্রিয় নাকি নিস্ক্রিয় থাকবে) এর সমস্যার কারণে(৬%) হতে পারে। এই রোগের অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন জেনেটিক কারণ থাকায় বংশপরম্পরায় এর সঞ্চারণ কৌশল একটু জটিল। নিচের চিত্রে এই রোগের বিভিন্ন কারণের রিস্ক ফ্যাক্টরের তুলনা দেখানো হল।  


প্রতি কোষে থাকা একই ক্রোমোজোমের দুইটির মধ্যে একটি মায়ের কাছে থেকে অপরটি বাবার কাছে থেকে আসে। বাবার দেহ থেকে আসা UBE3A সন্তানের দেহে স্বাভাবিকভাবেই নিস্ক্রিয় থাকে। তাই পিতার ক্রোমোজোমে জিন বিলুপ্তিকরণ থাকলেও তা সরাসরি রোগ সৃষ্টি করে না তবে পিতা বাহক হন এবং তার কন্যাও বাহক হয় ফলশ্রুতিতে কন্যার সন্তানেরা রোগ আক্রান্ত হতে পারেন। অপরদিকে মায়ের দেহ থেকে আসা ক্রোমোসোমের জিন যেহেতু সক্রিয় থাকে সেহেতু মায়ের জিনের বিলুপ্তিকরণ থাকলে তা সন্তানে সঞ্চারণযোগ্য। এই রোগের অন্যান্য কারণ গুলো(যেমনঃ ইউনিপ্যারেন্টাল ডাইসোমি, মিউটেশন, ইম্প্রিটিং সেন্টারের ত্রুটি) বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সন্তানের দেহে সঞ্চারণযোগ্য নয়। উল্লেখ্য যে মাতার বদলে পিতার দেহ থেকে আসা ১৫ নাম্বার ক্রোমোজোম যদি সক্রিয় থাকে তবে ঐ ক্রোমোজোমের একই জিন এবং এর আশেপাশের ব্যান্ডের ত্রুটির জন্য প্রাডে-উইলি সিনড্রোম নামে আরেকটি রোগ দেখা দেয় যা অ্যাঞ্জেলম্যান সিন্ড্রোম হতে ভিন্ন।
রোগ নির্ণয়ঃ
১। ক্রোমোজোম বিশ্লেষণঃ এতে সকল ক্রোমোজোমের কোন বিশাল অংশ অনুপস্থিত কিংবা পরিবর্তিত হয়েছে যা দৃশ্যমান গঠনগত ত্রুটি তৈরি করেছে কিনা দেখা হয়।
২। ফ্লুরোসেন্স ইন সিটু হাইব্রিডাইজেশনঃ এতে ১৫ নাম্বার ক্রোমোজোমের কোন ছোট অংশ হারিয়ে গিয়েছে কিনা দেখা হয়।
৩। ডিএনএ মিথাইলেশনঃ এতে দেখা হয় বাবা কিংবা মা কার দেহ থেকে আসা আলোচ্য জিন সন্তানের দেহে সক্রিয় আছে।এতে একই সাথে আলোচ্য জিনের কার্যগত ত্রুটি এবং ইউনিপ্যারেন্টাল ডাইসোমিও নির্ণয় করা যায়( বাবা কিংবা মা একজনের কাছে থেকে এক জোড়া ক্রোমোসোম চলে আসা)। এটি এই রোগ নির্ণয়ে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত পরীক্ষা।
৪। UBE3A জিন মিউটেশন বিশ্লেষণঃ এই জিনের মায়ের দেহ থেকে আসা ক্রোমোজোমে কোন মিউটেশন হয়েছে কিনা যার ফলে তা গঠনগত কারণে নিস্ক্রিয় হয়েছে কিনা।
চিকিৎসাঃ


এই রোগের জন্য এখনও স্বীকৃত কোন চিকিৎসা না থাকলেও বিগত ৫ বছর ধরে দুই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে কাজ চলছে যা নিয়ে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। তবে এই চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর উপকারিতা বোঝা নিতান্তই কষ্টসাধ্য কারণ এই পদ্ধতিগুলো দ্বারা রোগের আপাতদৃষ্টে বোঝা যায় এমন উন্নতি হতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। তাই ফ্রেব্রুয়ারি ৫ তারিখে Current Biology নামে জার্নালে এই রোগের উন্নতি পর্যবেক্ষণে এক নতুন বায়োমার্কার হিসাবে সারকার্ডিয়ান ছন্দের কথা বলা হয়েছে। “অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যাক্তির দেহের ধীর সারকার্ডিয়ান ছন্দ আমাদের সবচেয়ে দ্রুত বলে দিতে পারে আমাদের ব্যবহার করা ওষুধ কাজ করছে কিনা। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সারকার্ডিয়ান ছন্দ স্বাভাবিক হয়ে আসাটা নতুন পরীক্ষাধীন চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য বায়োমার্কার হতে পারে” বলছিলেন এই রোগ ও সারকার্ডিয়ান ছন্দের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় ও এই আর্টিকেলটির অন্যতম লেখক টেরি জো বিচেল। এই গবেষণার জ্যেষ্ঠ গবেশক প্রফেসর কার্ল জনসন বলেন “UBE3A জিন Ubiquitin ligase নামে এনজাইমের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রনে ভূমিকা রাখে এবং এই এনজাইম অন্য আরও প্রোটিনের কাজ নিয়ন্ত্রনে ভূমিকা রাখে। Ubiquitin ligase এনজাইমের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা অটিজমের কারণ হয় অপর দিকে কমে গেলে তা অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোমের কারণ হয়।“ আপাতত বিজ্ঞানীদের মধ্যে আশার সঞ্চারকারী চিকিৎসা পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হল তা বাবার কাছে থেকে আসা ক্রোমোজোমের UBE3A জিন কে সক্রিয় করে। এর মধ্যে একটি পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে Topotecan নামে টপোআইসোমারেজ কে বাঁধাদানকারী এক ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধী ওষুধ অপরটিতে অ্যান্টিসেন্স অলিগোনিউক্লিওটাইড নামে ছোট ডিএনএ অ্যানালগ যা ডিএনএ তে যুক্ত হয়ে বাবার কাছে থেকে আসা ক্রোমোজোমের UBE3A জিন কে সক্রিয় করে। এই ওষুধদ্বয় খুব দ্রুত সময়ে সারকার্ডিয়ান ছন্দকে স্বাভাবিক করার মাধ্যমে অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোমের রোগীর সবচেয়ে কষ্টদায়ক ঘুমের সমস্যা থেকেও ওষুধ প্রয়োগের পর দ্রুততম সময়ে রেহায় দেবে বলে বিজ্ঞানীদের আশা।


আশা করা যাচ্ছে শীঘ্রই আমরা এই রোগ চিকিৎসায় এক বিপ্লবের সাক্ষী হতে চলেছি।


- শুভাশীষ সাহা শুভ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ(চতুর্থ বর্ষ)


তথ্যসুত্রঃ

0 comments: