আমাদের সিজোফ্রেনিকতা

0
ইস্যু আসে ইস্যু যায়, টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোল হাতে দ্রুত চ্যানেল পাল্টানোর মতোই দ্রুত ইস্যূ পাল্টায়। আমরা এক উত্তেজনা থেকে আরেক উত্তেজনার দিকে ধাবিত হই। কোনো ইস্যুর পেছনেই লেগে থাকা হয় না, কোন ইস্যুরই শেষ দেখা হয় না। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যাক্তি যেমন আইডেন্টিটি সংকটে ভোগে, এক পরিচয় থেকে আরেক পরিচয় কে আকড়ে ধরে, কোন কিছুতেই স্থির হতে পারে না, কোন কিছুতেই বেশিক্ষন মনোযোগ রাখতে পারেনা, কোন বিষয়েইধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে না - সিজোফ্রেনিক সময়ও তেমনি জন্ম দিচ্ছে সিজোফ্রেনিক অ্যাক্টিভিজম, সিজোফ্রেনিক প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ এর। এম টিভিতে যেমন একটার পর একটা চকচকে উত্তেজনাকর ইমেজ আসতে থাকে, প্রিন্ট/ইলেক্ট্রনিক /অনলাইন মিডিয়াতেও একটার পর একটা ঘটনা সারফেসে ভেসে উঠে- আমরা নতুন উত্তেজনার খোরাক পাই, চ্যানেল পাল্টানোর মতো করেই ইস্যু পাল্টাই। তাতে আর কিছু হোক বা না হোক- বিবেক তো দায় মুক্ত হয়, ভার্চুয়াল অর্গাজম কিংবা থিয়েট্রিক্যাল ক্যাথারসিস এর পর কি আরামের শান্তির ঘুম আসে!


তলায় পড়ে থাকা বাস্তবতা কিন্তু সারফেস বা উপরিতলে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে উঠা ইস্যুগুলোর মতো সিজোফ্রেনিক নয়- “সুস্থ, স্বাভাবিক” . কি শান্ত স্থির অবিচল ধারাবাহিক ভাবে একটার পর একটা ঘটনা সারফেসে ভাসাচ্ছে/ডুবাচ্ছে এই “সুস্থ স্বাভাবিক” সিস্টেম। একটার পর একটা “ভেসে উঠা” ঘটনার ঘনঘটায় , তীব্রতায়, আঘাতে হতবাক, ক্ষুব্ধ, বিমুঢ় হয়ে যাই আমরা, খুজতে ভুলে যাই কিংবা খুজলেও পাই না কিংবা পেলেও দেখতে চাই না- এইসবের উৎস কি। ফলে সীমান্ত হত্যা, নিপীড়ন, তিস্তার পানি বন্টন, তিতাসে বাধ, টিপাইমুখ বাধ ইত্যাদি ভয়ংকর ঘটনাগুলো আলাদা আলাদা করে বিভিন্ন সময়ে আমাদের কাছে ভেসে উঠা “ইস্যু” হলেও এইসব ঘটনার উৎস হিসেবে “স্বাভাবিক সময়ে” ভারতের সাথে বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠীর নতুজানু নীতিকে দেখতে পাইনা। সৌদি আরবে বাংলাদেশী শ্রমিকদের শিরো:চ্ছেদ হলে আমরা ক্ষুব্ধ হই, তার পর ভুলে যাই, তারপর এরকম আরো কোন ঘটনায় ক্ষুব্ধ হওয়ার অপেক্ষায় থাকি—কিন্তু কেন বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে দেশের উন্নয়ণ মূলক কর্মকান্ড বাদ দিয়ে বিদেশে বিভিন্ন দেশের উন্নয়ণ মূলক কর্মকান্ডে শ্রম দিতে হয়, মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়, কেন দেশে কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা না করে বিদেশের ডার্টি-ডিফিকাল্ট-ডেনাজারস কাজে শ্রমিক রপ্তানি করাই দেশের শাসক গোষ্ঠীর সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়- সেই প্রশ্ন আমাদের মাথায় আসার আগেই আমরা আরেকটা তরতাজা ইস্যু পেয়ে যাই ক্ষুব্ধ হওয়ার জন্য। আমরা পারসোনার ক্যামেরা কেলেংকারি , রুমান মঞ্জুর, ভিকারুন্নেসা নুনে ছাত্রী নিপীড়ন,ইভটিজিং , ইউনুস বিতর্ক, বিয়ের আসরে তালাক, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কোরি, অরুণ চৌধুরি, সৈয়দ আবুল হোসেন, জাগো ফাউন্ডেশন, তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরের সড়ক দুর্ঘনায় মৃত্যু, ইলিয়াস গুম ইত্যাদি নানা ইস্যুতে একের পর এক ব্যাস্ত হয়ে পরি।

আমাদের অনেক কাজ- ইস্যুগুলোর শেষ দেখা, ভেসে উঠা ইস্যুগুলোর পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক খোজা কিংবা এগুলোর আড়ালের অন্য বাস্তবতা- যে বাস্তবতা এদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের প্রতিদিনের শ্রম-ঘাম নিংড়ে ছিবড়ে করছে, প্রতিদিন গুম, ক্রসফায়ার করছে, প্রতিনিয়ত দেশের স্বার্থ ভারত-চীন-মার্কিন স্বার্থের কাছে বিক্রি করছে, প্রতিদিন পুরুষতান্ত্রিকতার ছোবল দিচ্ছে নারীর উপর, নারীকে পণ্য বাণিয়ে, বিজ্ঞাপন-নাটক-সিনেমায় ভোগ্য হিসাবে হাজির করিয়ে ইভ-টিজিং এর বাস্তবতা তৈরী করছে, সেই বাস্তবতার খোজ নেয়া, জানতে বুঝতে শিখা এবং সার্বিক প্রতিরোধ গড়ার সময়, সুযোগ কিংবা “বাস্তবতা” কি আমাদের আছে?

আমরা হইলাম অনলাইন ভার্চুয়াল কমিউনিটি- একটার পর একটা ইস্যু নিয়ে ভারচুয়াল দুনিয়া গরম রাখতে গিয়া যে রীতিমত ঘামতেছি-সেইটাই বা কম কি!

0 comments: